ঢাকা,  শনিবার
২০ এপ্রিল ২০২৪

The Daily Messenger

জাতীয় খেলা হাডুডু কিন্তু জাতীয় চরিত্র!

প্রকাশিত: ১৫:২৯, ২৮ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ১৫:৩৫, ২৮ অক্টোবর ২০২২

জাতীয় খেলা হাডুডু কিন্তু জাতীয় চরিত্র!

আমি তখন (১৯৮৫) সুইডেনের লিনসোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্টে প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমার তখনকার সময়ের এক বাংলাদেশি থাকে সুইডেনে জেনেছে আমি গ্রাম থেকে এসেছি। সে নাকি কোনোদিন ঢাকার বাইরে যায়নি। গ্রাম সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, এমনটাই মনে হতো তার কথায়। কোনো এক প্রসঙ্গে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ধানের গাছ দিয়ে কী করে গ্রামে? আমি তাকে ইচ্ছে করেই বলেছিলাম, নানা ধরনের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে গরু ছাগলের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে ইচ্ছাকৃতভাবে জেনে না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করেছিল কিনা জানিনা। তবে বলেছিলাম মুখের উপর, “শালা বাঙালি হয়ে বাংলার খবর রাখো না?”

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ বাংলাদেশের কথা শুনলে তাদের মনেও প্রশ্ন জাগতে পারে "বাংলাদেশ একটি মাফিয়া রাষ্ট্র কি-না?" বিদেশীদের মাঝে এ ধারণার বীজ ছড়ানোর জন্য কিছু লোক কাজ করছে। কারণ দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মতো সাংবাদিকের অভাব নেই। কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশকে জানি এবং বুঝি, তাদের কাছে দেশের আসল রূপ অজানা নয়।

বর্তমানে বিশ্বে সমস্যার শেষ নেই এবং সমস্যা ছাড়া মানুষ জাতির বসত কোথাও আছে বলে আমার জানা নাই। তবে বাংলাদেশের মতো শত শত জেনারেল আজিজ এবং পুলিশের আইজিপি বেনোজিরের ইতিহাস আমরা যে জানিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারব। সন্ত্রাসী, মাফিয়া বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও রয়েছে। তবে ঘুষ এবং দুর্নীতিতে বাংলাদেশ যে প্রথম সারিতে সে বিষয় আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত।

তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় জেনারেল আজিজের ভাইদের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়, কারণ তারা তখন আওয়ামী লীগের অনেকের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করেছে। নিজেদের জীবন বাজি রেখে শুনেছি অনেকের জীবনকে বাঁচিয়েছে। বিরোধী দল যেমন এখন সর্বহারা, তখনকার বিরোধিদলের অবস্থাও কিন্তু এখনকার মতো ছিল। কারণ বাংলাদেশ প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং সেই রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সেক্ষেত্রে অনেকের ধারণা এমনও তো হতে পারে রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে ফাঁসানো হয়েছে!

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে তাঁর প্রবাসী ভাইয়েরা যোগাযোগ রাখেন। পরিবারে বিয়েসাদীর মতো অনুষ্ঠানেও তাঁরা যোগ দেয়। ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের যোগাযোগ থাকবে না? সেনাপ্রধান আজিজের সঙ্গে তাঁর আপন ভাই যোগাযোগ রাখে, এটি জেনে আমাদের অবাক হওয়ার কারণ নেই। তিনি তাঁর ভাইয়ের প্রতি স্নেহশীল হবেন, তাঁকে ভাল রাখার জন্য চেষ্টা করবেন, তাতেই বা বিস্ময়ের কী আছে? এটাই কিন্তু প্রকৃত বাংলাদেশ এবং প্রতিটি পরিবার ঘাটলে এ ধরণের নজিরের অভাব হবে না।

মনে কি পড়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার হত্যাকারী কর্নেল ফারুক, রশিদ এবং অন্যরা কিভাবে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে নেমেছিল। কারা তাদের অস্ত্র, অর্থ, পৃষ্ঠপোষকতা তথা সরকারি সুযোগসুবিধা দিয়ে মাঠে নামিয়েছিল?

বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে সেসময় রাষ্ট্র প্রোটেকশন দেয়নি, আর্মি বা পুলিশ তার প্রাণ বাঁচায়নি, তাঁর দলের নিবেদিত কর্মীরাই বারবার মানবঢাল তৈরি করে এবং নিজেদের জীবন দিয়ে তাঁদের নেত্রীর প্রাণ বাঁচিয়েছে। যারা ঝুঁকি নিয়েছে তাদের প্রতি যে দায়বোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং স্নেহশীল আচরণ তা আমি সম্মানের সঙ্গে দেখছি। এদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না আসতে পারলে সে বিচার কখনও হতো বলে মনে হয় না।

আবার পরিবারের কেউ মামলা মোকদ্দমায় আসামি হলে আমরা কি তাদের সহযোগিতা করি না? তবে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আর্মি হেড কোয়ার্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে যদি সত্যিকারার্থে অপরাধীদের অংশগ্রহণ থেকে থাকে তাহলে বলা যেতে পারে দেশের অবস্থা সংকটজনক। প্রশাসনের উপস্থিতিতে যদি এসব ঘটে তবে জনগণ হতাশ হতেই পারে। তারপর সেনাবাহিনীর সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কে বা কারা জড়িত, দেশের অর্থ কে বা কারা নষ্ট করছে, বিষয়টি যদি এমন হয় সেনাপ্রধান তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বা দেশদ্রোহী হয়েছে, তাহলে অন্যায়ের শাস্তি হওয়া উচিত। সেনাসরঞ্জাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত আদৌ কিনেছিল কিনা এবং কিনে থাকলেও তাতে দুর্নীতি হয়েছিল কিনা, দুই টাকার জিনিস পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে দেশের ক্ষতি করা হয়েছিল কিনা এসব তদন্তের বিষয়।

দেশে দুই ধারার মানুষ আছে। কেউ কেউ যেমন অতীতে বলেছিল "মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেবো," এই স্লোগান যাদের রক্তে বোধের অনুকরণ ঘটায় তাদের সেন্টিমেন্ট একরকম। অন্যদিকে যারা সবসময় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখার মধ্যে শান্তি খুঁজে পায়, তাদের সেন্টিমেন্ট অন্যরকম।

আবার যারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, তারা পাকিস্তানিদের চোখে সন্ত্রাসী, আমাদের নিজেদের চোখে বীর। খুনি ফ্রীডম পার্টি ও তার সহযোগী পৃষ্ঠপোষকদের কাছে শেখ হাসিনার উপর আক্রমণকারীরা বীর, আমাদের চোখে হাসিনার জীবন রক্ষায় যারা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাঁরাই সম্মানিত অগ্রসেনা। এমন করেও ভাবা যেতে পারে। এসব ছিল অতীতের ঘটনাপ্রবাহ যা পুরো দেশের মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলছে। কিছু দিন যেতে না যেতেই দেখা যাবে নতুন আরেকটি খবর আসবে তখন এসব খবর ঢাকা পড়ে যাবে। এইভাবেই কিন্তু দেশটি চলছে।

আমরা জনগণ হয়েছি দর্শক। নিজেরা খেলি না, খেলা দেখি। সারাক্ষণ ব্যস্ত খেলা দেখা নিয়ে। আগে কিছু টাকা পয়সার বিনিময়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতাম, এখন সেটা বন্ধ হবার কারণে সে কাজটিও নেই। ইদানীং খেলা দেখতেও ভালো লাগে না। কারণ একটি খেলা শেষ না হতেই আরেকটি শুরু, কোনটা রেখে কোনটা দেখব?

ইদানীং আবার বাংলাদেশের সাংবাদিকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে, দেশি এবং বিদেশি। যারা দেশে তারা সব জেনে শুনেও না জানার ভান ধরে চুপচাপ আছে। আবার যারা দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রিত তারা সব না জেনেও বেশি জানার ভান করে গুজব ছড়াচ্ছে। যার ফলে সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারছে না এবং খেলাও ভালো জমছে না। এই সুযোগে বাইরের সাংবাদিকরা দেশের খবর এলোপাতাড়িভাবে প্রচার করে প্রকৃত খবরের বারোটা বাজিয়ে জগাখিচুড়ি করে ফেলছে। ফলে খেলা দেখে মজা নেই।
 
একটি পুরাতন গল্প মনে পড়ে গেল। রাজার দেহরক্ষী রাতে রাজার রাজ প্রাসাদ পাহারা দিয়েছেন। সকালে রাজা মহোদয় বাইরে বের হতেই প্রহরী বিনয়ের সঙ্গে রাজাকে বললেন, মহারাজ আমি রাতে স্বপ্নে দেখেছি আজ আপনার বিপদ হবে ঘরের বাইরে গেলে। রাজা মহোদয় দেহরক্ষীর কথা মত ঘরে থেকে গেলেন, তবে দেহরক্ষীকে তার কর্ম থেকে অব্যহতি দিয়েছিলেন। গল্পটি মনে হয় বাংলাদেশের সবাই জানে তাই কেউই প্রধানমন্ত্রীকে বলছে না সত্য কথাগুলো বরং সামাজিক গণমাধ্যম এবং মূলধারার মাধ্যমে অনেককেই দেখা যাচ্ছে, তাঁরা প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন এটা প্রমাণ করার, আমরা প্রধানমন্ত্রীর লোক।

কেউ করছেন ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতে একটি ফ্রেম ব্যবহার করে, যাতে লেখা আছে, ‘উই আর প্রাইম মিনিস্টারস মেন’। কেউ বলছে না ভুল তথ্যের জবাব হচ্ছে সঠিক তথ্য প্রকাশ। আর অপপ্রচার থেকে বাঁচা বা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের উপায়ও আসল সত্য তুলে ধরা। ভিন্নমতের জবাব দিতে হবে পাল্টা যুক্তিতে। সরকারকে সেই সুপরামর্শ না দিয়ে যে পথটি অনুসরণে উৎসাহিত করা হচ্ছে তা সঠিক পথ নয়।

বাংলাদেশের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি হয়েছে মাকাল ফলের মতো। বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর, ভিতরে নোংরা এবং অখাদ্য। আবার দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল যার বাইরে কাটা অথচ ভিতরে শত শত সুস্বাদু রসে ভরা কী চমৎকার মজাদার খাবার! দেশের মানুষের চরিত্র মাকাল ফলের চেয়েও খারাপ কারণ মাকাল ফল অগত্যা দেখতে ভালো।

যে দেশের জাতীয় খেলা হাডুডু বা কাবাডি যাই হোক না কেন, জিততে হলে টেনে ধরে রাখতে হবে, সামনে যেতে দেওয়া যাবে না। এবং যে দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল যার মধ্য রয়েছে শত শত রসাল ফল এবং বিচি, সেই দেশের মানুষ আমরা! কী জানি, বোঝা মুসকিল! কীভাবে এবং কবে আমরা বাঙালি হবো, বাংলাদেশি আর কবেই বা হবে আমাদের জাতীয় চরিত্রের সনাক্তকরণ?

ইমেইল: [email protected]

ডিএম/ইএইচএম

dwl
×
Nagad