
ছবি : মেসেঞ্জার
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের আটতলা ভবনটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভয়াল সেই স্মৃতির কথা মনে পড়লে আজও বিমর্ষ হন ভুক্তভোগীরা। ১১ বছর পর নিশ্চিন্তপুরের ভবনটি দাঁড়িয়ে থাকলেও একসময়ের কর্মঠ শ্রমিকরা এখন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। শারীরিক যন্ত্রণা, সংসারের অনটনের পাশাপাশি দোষীদের শাস্তি না পাওয়ার আক্ষেপে দিন কাটছে তাদের।
সেই ট্র্যাজেডির ১১ বছর পূর্তিতে শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকালে নিহত শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানাতে তুবা গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনের সামনে এসেছিলেন নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলছেন, ১০ বছরেও হতাহত শ্রমিকরা পায়নি পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসা। এছাড়া সরকার ও বিজিএমইএর কাছ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী মেলেনি প্রাপ্তি।
সেদিন চতুর্থ তলায় কর্মরত ছিলেন সুইং অপারেটর নাসিমা আক্তার। মারা যাওয়া সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ তিনিও এসেছিলেন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাসিমা বলেন, সেদিন শিপমেন্টের তারিখ ছিল। তাই বের হতে দেরি হচ্ছিল। সন্ধ্যায় আগুন লাগে। ফায়ার অ্যালার্ম বাজলে সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে সুপারভাইজার বকাবকি করেন। তৃতীয় তলায় নেমে দেখেন কলাপসিবল গেট আটকানো। একটা রুমের জানালা ভেঙে ওইখানে আটকা পরা সবাইকে ঠেলা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁর হাত-পা ভেঙে যায়।
দুঃখ করে নাসিমা আক্তার বলেন, কাজের জন্য কোনো গার্মেন্টসে গেলে আগে তাজরীনে কাজ করছি বলার পর আর কাজে নেয় না। তিন মাস ধরে একটা ঝুটের কারখানায় কাজ করতেছি।
অনেকের মতো চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হওয়া শ্রমিক পারভিন আক্তার বলেন, সারা শরীরের ব্যথায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। কানেও কম শুনি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা করে। গার্মেন্টসে কাজ নিলেও অসুস্থতার জন্য টার্গেট পূরণ করতে পারি না। তাই গার্মেন্টসে কাজ করতে পারি না। বেঁচে থেকেও কাজ করতে পারি না, মরার মতো বেঁচে আছি।
আহত শ্রমিক রেহেনা আক্তার বলেন, আগুনে সব শেষ হয়ে গেছে। আগে কাজ করে আয় করে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করতে পেরেছি। এখন অন্যের ওপর ভরসা করতে হয়, এটা কোন জীবন হলো।
আহত শ্রমিক নাজমা বেগম বলেন, এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। ক্ষতিপূরণ এখনো পাইনি। এখনো ঠিকভাবে সুস্থ হতে পারিনি। তাজরিন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডের সময় মূল ফটক তালাবদ্ধ ছিলো বলে জানান শ্রমিকরা।
সেদিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আনজুমা আক্তারের দায়িত্ব ছিল কারখানার পঞ্চম তলায়। তিনি বলেন, আগুন দেখে সিকিউরিটিকে গেট খুলতে বলি, খুলে নাই। ১২ থেকে ১৪ জন মিলে জানালার রড ফাঁকা কইরা পাশের দোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে লাফ দিই। অনেকেই বের হইছে ওই জানালা দিয়া।
সরেজমিনে আজ সকাল ৭টার দিকে তাজরীন ফ্যাশনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাটির ৯ তলা ভবনটি ঘটনার পর থেকে খালি পড়ে আছে। ভবনের মূল ফটকের সামনে অপেক্ষা করছেন সেদিনের ঘটনায় আহত বেশ কয়েকজন শ্রমিক, নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ফটকের সামনে ফুল দিয়ে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম। এ সময় শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদ নাসের উপস্থিত ছিলেন।
পরে সেখানে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স (ইউএফজিডব্লিউ), গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগ, গার্মেন্ট শ্রমিক ফ্রন্ট আশুলিয়া-সাভার শিল্পাঞ্চল কমিটি, বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন সাভার আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটি, গার্মেন্টস শ্রমিক ও শিল্পরক্ষা জাতীয় মঞ্চ, টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের নেতা-কর্মী ও নিহত শ্রমিকদের স্বজনেরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে একই স্থানে সমাবেশ করে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী ও আহত শ্রমিকেরা সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি জানিয়ে বক্তব্য দেন।
বক্তারা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তি, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহ পুনর্বাসন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের জন্য আর্থিক বরাদ্দ, নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে তাজরীন ফ্যাশনের সামনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবিসহ বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে মুক্তির দাবি জানান।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন বলেন, ১১ বছর পার হলেও তাজরীনের ঘটনায় কোনো বিচার হয়নি বরং পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছেন মালিক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছে। এটা একধরনের পুরস্কার।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে বলা হচ্ছে সাক্ষী পাওয়া না যাওয়ায় মামলা শেষ করা যাচ্ছে না। অথচ আহত শ্রমিক, স্থানীয়সহ সবাই আছেন সাক্ষ্য দিতে। এটি একধরনের বিচার না করার অজুহাত মাত্র।
শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলায় ইতিমধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বিচার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সব প্রকার সহযোগিতা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সে বিষয়ে তাঁরা সোচ্চার আছেন।
প্রসঙ্গত, তাজরীন ফ্যাশন কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১৩ জন শ্রমিক মারা যান। আর আহত প্রায় দুই শতাধিক শ্রমিক পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কারখানাটিতে ১১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন, দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। মরদেহ শনাক্ত হওয়ায় ৫৮ জনকে পরিবার ও স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অন্যদের মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায় তাদের জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মেসেঞ্জার/নোমান/আপেল