
ছবি : টিডিএম
যেদিকে দুচোখ যায়, শুধু পানি, আর পানি। মাঝখান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে আঁকা-বাঁকা আঞ্চলিক পিচঢালা পাকা সড়ক। সড়কের দুই পাশ দিয়ে মুক্ত বাতাসে নৌকা ও স্পিড বোর্ডে ঘুরছে ভ্রমণপ্রিয় মানুষেরা। একই সঙ্গে সড়ক দিয়ে ছুটে চলছে বিভিন্ন যানবাহন।
মাথার ওপর নীল আকাশ আর পানিতে সূর্যের কিরণের মুগ্ধতায় পানির উপর গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান জলডাঙ্গা কফি হাউজ এন্ড রেস্টুরেন্ট।
জলডাঙ্গা কফি হাউজ এন্ড রেস্টুরেন্টির অবস্থান সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার উধুনিয়া এলাকায়। এই কফি হাউজ ও রেস্টুরেন্টির ব্যাপক পরিচিতি পাওয়ায় বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণ পিসাসুরা ছুটে আসছে এ জায়গায়। এটাকে ভালবেসে নাম দিয়েছে অনেকে সিরাজগঞ্জের মিঠামইন। মনোমুগ্ধকর এই স্থানটিকে পর্যটন এলাকায় গড়ে তোলার দাবি ভ্রমনপিপাসু ও স্থানীয়দের।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জেলার উল্লাপাড়ার শহর থেকে উধুনিয়া ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়কটি এক সময় চরম বিপর্যস্থ ছিল। এ সড়ক পথে ছোট ও বড় যানবাহন চলাচল তো দুরের কথা। পায়ে হেটেও চলাচলের উপযোগী ছিলো না। বর্তমান ক্ষমতাশীন সরকার গত দুই বছর আগে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যায়ে সড়কটি সংস্কার ও বর্ধিত করা হয়।
এ কারণে অবহেলিত চলনবিলের বুকচিরে নির্মিত আঁকা-বাঁকা সড়কটি বদলে দিয়েছে এখানকার চিত্র। বর্তমানে সড়কটি নির্মাণ ঘিরে দুই ধারে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কফি হাউজসহ বিভিন্ন রকমের বিনোদন কেন্দ্র। ২০ কি.মি. আঞ্চলিক সড়কটিতে গঠে উঠেছে জলডাঙ্গা কফি হাউজ এন্ড রেস্টুরেন্ট।
জলডাঙ্গা কফি হাউজ এন্ড রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, উধুনিয়া এলাকায় ৪৫ শতক জায়গায় পানির উপরে ৫ শতাধিক বড় আকারের প্লাষ্টিক ড্রাম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান এই কফি হাউজ এন্ড রেষ্টুরেন্টটি। আঁকা-বাঁকা আঞ্চলিক সড়কে উড়ন্ত ঈগল। এমন প্রতিকৃতিতে রেষ্টুরেন্টটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে। আঞ্চলিক এই সড়কটি থেকে ভাসমান ব্রীজ দিয়ে পানির উপর প্লাষ্টিকের ড্রাম, কাঠ, লোহার আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছে এই অভিনব ভাসমান রেস্টুরেন্টটি।
প্লাস্টিকের ড্রাম, কাঠ ও লোহার উপরে বিছানো হয়েছে কাঠের পাটাতন। সেখানে নয়টি ছনের সু-উচ্চ গোল ঘর নির্মান করা হয়েছে। সেই ঘরের ভিতর চেয়ার টেবিল সাজানো আছে। এখানেই কমিউনিটি সেন্টার, পার্টি সেন্টার, পরিচালকের কক্ষ, রান্না ঘর টয়লেট ও পুরো রেস্টুরেন্টে নানা ধরণের ফুলসহ অনেক গাছ বসিয়ে সবুজায়ন আর নান্দনিক রুপ দেয়া হয়েছে।
এই রেস্টুরেন্টিতে এক সঙ্গে ৩ শতাধিক অতিথির খাবার সু ব্যবস্থা রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে জলডাঙ্গা কফি হাউজ এন্ড রেস্টুরেন্টটি পানিতে ভাসে। জমি থেকে পানি নেমে গেলে রেস্টুরেন্টি উচু থাকে। বর্তমানে পানির উপরে ভাসছে।
রেস্টুরেন্টের কর্মচারী শফিকুল ও আলতাব বলেন, এখানে খাবার ব্যবস্থায় রয়েছে চলনবিলের মিঠা পানির দেশি টাটকা বিভিন্ন রকমের মাছ, হাঁস, দেশি মুরগীর মাংসসহ দেশি-বিদেশী খাবারের ব্যবস্থা। একই সঙ্গে রয়েছে চা, কফি, কোমল পানি, লাচ্ছিসহ মুখরোাচক খাবার। এই খাবারগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে ভ্রমণ পিপাসুদের পরিবেশন করেন।
ঘুরতে আসা মাহবুব শেখ বলেন, জায়গাটা অনেক সুন্দর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশুদ্ধ বাতাস সব কিছু মিলে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। এখানে এলে ভালোই লাগে।
তিনি আরও বলেন, জলডাঙ্গা রেস্টুরেন্টের মাথার উপর মুক্ত আকাশ আর চারদিকে ঘুরছে অসংখ্যা নৌকা ও স্পীড বোর্ড। এই রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য বসে হিমেল হাওয়া আর পানির ঢেউয়ে দুলতে দুলতে খাবার খেতে ক্ষনিকের জন্য হারিয়ে যেতে হয় অজানায়। পানির ডেউ আর কল-কল শব্দে বিমোহিত হয় যায় মন।
পরিবার নিয়ে ঘরতে আসা নীরব হোসেন বলেন, সারাদিন নৌকায় ছুটে চলেছি। সন্ধার পর রেষ্টুরেন্টটির চমৎকাল লাইটিং দুর থেকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। পরে মনোমুগ্ধকর পরিবেশের কারণে ছুটে এসেছি। এমন পরিবেশের কারণে রেস্টুরেন্টটি ইতিমধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
ছুটির দিনে ঘুরতে আসা নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শামসুল আলম স্বপন জানান, ছুটির দিনে বন্ধুদের নিয়ে অবসর সময় এখানে আসি। এই রেস্টুরেন্ট এবং জায়গাটি চমৎকার এবং মনোমুগ্ধকর। নিরিবিলি পরিবেশ দেখে আমার খুব ভালোলাগে। ক্ষনিকের জন্য মন হারিয়ে যায় অজানায়।
কিভাবে যাবেন: পানির উপরে ভাসমান জলডাঙ্গা কফি হাউজ এন্ড রেস্টুরেন্টিতে আসার জন্য উল্লাপাড়া উপজেলা শহর থেকে যে কোন যানবাহনে উধুনিয়া এলাকায় আসা যাওয়া যায়। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে ঘুরতে আসছে হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা।
জলডাঙ্গা কফি হাউজ এন্ড রেস্টুরেন্ট এর পরিচালক মো. বকুল হোসেন বলেন, আমরা ১২ জন মিলে ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই রেস্টুরেন্টটি নির্মান করেছি। এটি দেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান রেস্টুরেন্ট। এখানে দেশি ও বিদেশী সব রকম খাবার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের রেস্টুরেন্টে প্রায় ২ হাজারের মতো অতিথি আসেন। তাদের সার্বিক নিরাপত্তাসহ সেবা দিয়ে থাকি। আমাদের রেস্টুরেন্টটি আরও দৃষ্টিনন্দন করা কাজ চলছে। আমরা শুধু ব্যবসা নয় মানুষদের বিনোদন এবং সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি।
উধুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বাচ্চু বলেন, শুষ্ক মৌসুমে সবুজ ধান আর সরিষায় মন ভরে যায় এবং বর্ষা মৌসুমে পানি আর পানি দেখতে প্রতিদিন ভ্রমণ পিপাসুদের সমাগম হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, উল্লাপাড়ার সংসদ সদস্য তানভীর ইমামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আঞ্চলিক সড়কটি সংস্কার ও বর্ধিত হওয়ায় এই পিছিয়ে পড়া অঞ্চলটি এখন শহরে রুপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে এখানকার মানুষের জীবন যাত্রায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এই স্থানটি আরও সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য সংসদ সদস্য মহোদয়কে অবগত করা হয়েছে।
উল্লাপাড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, রাস্তার পাশে বসার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। দুর-দুরান্তসহ স্থানীয় ভ্রমণ পিপাসুদের নিরাপত্তার জন্য সব সময়ই পুলিশের টহল রয়েছে। এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা ভালোবাবে ঘুরে ফিরে যেতে পারবে সে বিষয়েও নজর রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।
টিডিএম/এএম