ঢাকা,  রোববার
০৬ জুলাই ২০২৫

The Daily Messenger

বন্ধ ফুড ভিলেজ প্লাস, থামবে না আর কোন গাড়ী

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯:২২, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বন্ধ ফুড ভিলেজ প্লাস, থামবে না আর কোন গাড়ী

ছবি : টিডিএম

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় অবস্থিত এস. আর গ্রুপের ‘ফুড ভিলেজ প্লাস’ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২২টি জেলার মানুষের পরিচিত হোটেলটি বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে মালিকপক্ষ। ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে রেস্টুরেন্টটির মালিক বগুড়া সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ হোটেলটি স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছেন।

মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ফুড ভিলেজ প্লাসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডি.জি.এম) সাগর আহম্মেদ এতথ্য নিশ্চিত করে জানান, ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের জন্য মালিকপক্ষ এই হোটেলটি স্থানীয়ভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে থামবে না আর কোনো গাড়ী।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় গড়ে ওঠেছিলো ফুড ভিলেজ হোটেলটি। বর্তমানে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের চার লেনের কাজ চলছে। একই সঙ্গে হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কাজও চলছে। একারনেই ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দিন-রাত হোটেলটি চালু থাকায় একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিলো প্রায় ৫০টিরও বেশি ছোট-বড় দোকান। 

হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় এই ব্যবসায়ীরা কোথায় যাবেন তা জানেন না তারা। এ ছাড়াও এখন দূরপাপ্লার এই বাসগুলো কোথায় যাত্রা বিরতি দেবে এমন প্রশ্নও রয়ে গেছে। হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন ঢাকা-পাবনা রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা।

এস.আর গ্রুপের হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট ফুড ভিলেজ প্লাস সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলটি উদ্বোধন করেন এস.আর গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। সেদিন থেকে যাত্রা শুরু হয়ে প্রায় ১০ বছর পর করে বন্ধ হয়ে গেল হোটেলটি।

হোটেলের সামনে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন আলা উদ্দিন, শফিকুল ও রফিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন জানান, এখানে রাত-দিন উত্তরবঙ্গের সব জেলার গাড়িগুলো দাঁড়াতো। এই যাত্রীরা হোটেলের সামনের দোকানগুলো থেকে পান, চিপস, পানীয় কেনাকাটা করতেন। এই হাজার হাজার মানুষের কাছে পণ্য বেচেই চলতো আমাদের জীবিকা। এখন হোটেল বন্ধ হয়ে গেল। এখানে আর কোনো বাসও দাঁড়াবে না। তাই আমাদের এখানে আর ব্যবসা করার সুযোগ নেই। জানি না কোথায় গিয়ে নতুন করে আবার ব্যবসা শুরু করব। হোটেলটা বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়লাম আমরা।

ফুড ভিলেজ প্লাসে কাজ করা জাহিদুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক বলেন, ফুড ভিলেজটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হোটেলের বিভিন্ন পদে প্রায় ৬০০ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়লো। এখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বারবিকিউ, চাইনিজ, বাবুর্চি, ওয়েটার ও সহকারীসহ প্রায়  ৬০০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় সবাই কর্মহীন হয়ে পড়বেন। তবে হোটেলটি বন্ধ হয়ে গেলেও আমরা এখন পর্যন্ত বেতন পাইনি। বেতন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মালিক পক্ষ।

শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার এরশাদ আলী বলেন, এখন থেকে ১৬ মাইল এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের সব বাস হোটেল হানিফে দাঁড়াবে। তাদের হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় একটি হোটেল থাকলেও সেটি আপাতত বন্ধ আছে। তবে হাটিকুরুল গোলচত্বর এলাকায় দাঁড়ানো বাসগুলো ধরে রাখতে তারা আপাতত ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্প শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সেটি পুনরায় চালু করবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

নওগাঁ বাস মালিক সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কের উন্নয়ন কাজের জন্য ফুড ভিলেজ হোটেলটি বন্ধ হয়েছে। এ কারণে আমার যে নিজস্ব পরিবহন আছে এস.পি ট্রাভেল সেটা অলরেডি ফুড গার্ডেন নামে আরেকটি হোটেলের সঙ্গে কথা বলে সেখানে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সকল গাড়ীর মালিক পক্ষই এখন অন্য কোন হোটেলের সঙ্গে কথা বলে সেখানে দাড়ানোর ব্যবস্থা করছে। আমরা আলোচনা সাপেক্ষে দ্রুতই গাড়িগুলো মহাসড়কের বিভিন্ন হোটেলে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করবো।

তিনি আরও বলেন, হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়েছেন ঢাকা থেকে পাবনাগামী যাত্রীরা। পাবনার পরে হাটিকমুরুল গোলচত্বর হয়ে আলেঙ্গার আগে কোন উন্নত মানের হোটেল নাই। বাসগুলো কোথায় যাত্রাবিরতি দেবে তা নিয়ে এখন পর্যন্ত বলতে পারছেন না তারা। তবে পাবনা ও নওগা বাস মালিক সমিতির নেতারা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদরুল কবীর বলেন, ফুড ভিলেজ বন্ধ হওয়ায় মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে কোন যানজটের সৃষ্টির কোন সমস্যা হবে না। তবে পাবনাগামী বা ঢাকাগামী যে বাস যাত্রীগুলো আছে তাদের জন্য একটা বড় সমস্যা হবে।

তিনি বলেন, রাজশাহী ও বগুড়াগামী রোডে খুব ভালো হোটেল না থাকলেও কিছু হোটেল আছে। কিন্তু পাবনা রোডে যাত্রাবিরতি দেওয়ার মতো কোনো হোটেলই নেই। হয় এলেঙ্গা বিরতি দিতে হবে না হলে একদম পাবনা গিয়ে। তবে এটা শিশু ও বয়স্কযাত্রীদের জন্য কষ্টকর হবে।

পাবনা বাস মালিক সমিতির অফিস সচিব আমিনুল ইসলাম বাবলু বলেন, হোটেল বন্ধ হওয়ায় বাসগুলো এখন কোথায় দাঁড়াবে সেটা নিয়ে চিন্তায় আছেন মালিক পক্ষরা। যেমন যাত্রীদের জন্য সমস্যা, তেমনই সমস্যা হলো বাস মালিকদেরও। তবে আশা করছি খুব দ্রুতই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত চলে আসব।

ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলের সিনিয়র উপ-মহা-ব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান রেজা সাগর বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর সুনামের সঙ্গে সেবা দেওয়ার পর বর্তমানে ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে হোটেলটি বন্ধ করে দিতে হলো। এই হোটেলটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে একটা সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছিলো। এখন হাটিকুরুল এলাকায় আর দূরপাল্লার ভালো বাসগুলোর যাত্রাবিরতি দেওয়ার তেমন কোনো জায়গাও থাকলো না। ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলটি কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগা ও বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলার বাস যাত্রাবিরতি দিতো। এখন তারা আর এখানে বিরতি দিবে না। আর সেই পরিচিত ড্রাইভার ও সুপার ভাইজারদের সঙ্গে কথাও হবে না।

শাহজাহান রেজা সাগর আরও বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত অন্য কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তেমন কোন জায়গাও পাওয়া যয়নি। বিষয়গুলো নিয়ে সাসেক প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা নলকা ব্রিজের আশপাশে ভালো কোন জায়গার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। জায়গা পেলেই সেখানে চলে যেতে পারি। এখন পর্যন্ত আমাদের এমনই চিন্তাভাবন রয়েছে।

হাটিকুমরুল এলাকার নিউ-টাউন হাট-বাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. রেজাউল করিম বলেন, ফুড ভিলেজ হওয়ার আগে জায়গাটি পতিত ছিল। সেখানে পতিত জায়গার পাশাপাশি ছোট-খাটো বিভিন্ন খানাখন্দও ছিল। শুনেছি ওই জায়গাটি সরকারি ছিলো। তবে হোটেল মালিক ওই জায়গা লিজ নেওয়ার পরে সেখানে হোটেল তৈরী করেছিলো।

সাসেক-২ এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহবুব রাসেল বলেন, ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে হোটেলের জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করেছে। তারপরও তারা (হোটেল কর্তৃপক্ষ) যেতে যাচ্ছিল না। তাদেরকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করা হয়েছে। পরে তারা হোটেলটি বন্ধ করে দিয়েছেন। আগামী ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে হোটেলটি ভাঙ্গা শুরু হবে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, হোটেলের ২ দশমিক ৬৭ একর জায়গা ২০১৩ ও ২০১৮ সালে দুই মেয়াদে ৫ বছর করে মোট ১০ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালে লিজ মূল্য ছিল ২ কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪০ টাকা। তবে ঢাকা অফিস থেকে তারা লিজ নেওয়ায় আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারছি না। এ ছাড়াও ফুড ভিলেজ করার আগে ওই জায়গা পতিত ছিলো।

তিনি আরও বলেন, তারা জায়গাটি নিয়ে মামলা করায় আমরা তেমন কিছু করতে পারছিলাম না। এদিকে ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পে জায়গাটি প্রয়োজন হওয়ায় সরকার অধিগ্রহণের কাজও সম্পন্ন করেছে। এখন সেখানে সাসেক তাদের প্রকল্পের কাজ করবে।

টিডিএম/এফএমটি