ঢাকা,  শনিবার
২৭ জুলাই ২০২৪

The Daily Messenger

হোগলা পাতায় সফল উদ্যোক্তা মাফুজুল গণি

আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাভার

প্রকাশিত: ১৬:৫২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

হোগলা পাতায় সফল উদ্যোক্তা মাফুজুল গণি

ছবি : টিডিএম

মাফুজুল গণি, বয়স ৩০ বছর ছুঁইছুঁই। এরই মধ্যে নিজেকে গড়ে তুলেছেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থান, কেড়েছেন বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টি। দেশীয় কাঁচামাল শ্রম আর মেধার সমন্বয়ে হোগলা পাতা পণ্যে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। নোনা জলের গাছ হোগলা। এই গাছ মাটির ওপরে ৭৬-৯০ ইঞ্চি লম্বা হয়। প্রস্থ ইঞ্চি। শিকড় মাটিতে থাকে ১০-১২ ইঞ্চি।

গোড়ার দিকের শিকড় খানিকটা কচু গাছের মতো। নদীর দুই ধারে জন্মায় হোগলা গাছ। প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ হোগলা গাছ পেয়ে থাকে। এটি গ্রামীণ পরিবেশে বিশেষ করে নদীর দুই ধারে জন্মানো একটি পাতাসর্বস্ব গাছ। জুলাই-আগস্টে গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়।

তরুণ উদ্যোক্তা মো. মাফুজুল গণির জন্ম বেড়ে ওঠা দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায়। বাবা মো. ওসমান গণি ছিলেন স্থানীয় একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক মা মঞ্জুরা তৈয়বা গৃহিণী। এসএসসি এইচএসসির পর ভর্তি হন ঢাকার ধানমন্ডি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে।

টেক্সটাইল বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন ২০১১ সালে। সাভারের একটি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নি শেষে সেখানেই চাকরিতে যোগ দেন। এর পরের গল্পটা স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন ভাঙার বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার।

মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সাভারের ভাটপাড়া এলাকায় গড়ে তোলা গণি ক্রিয়েশন কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, টিনের শেড দেয়া লম্বা একটি ঘরেই চলছে হোগলা পাতার দড়িতে কারুপণ্য তৈরির কর্মযজ্ঞ। দুই পাশে থরে থরে সাজানো ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত কারুপণ্য। দারুণ মিশুক আর তারুণ্যদীপ্ত মাফুজুল গণি বীরদর্পে মাড়িয়ে আসা গল্পের ঝুড়ি খুলে বললেন, আজকের অবস্থানে আসা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল।

শুরুটা ছিল চাকরিতে থাকার সময়কালে। ওই সময়ে তার কাছে প্রচুরসংখ্যক মানুষ আসত চাকরির আবদার নিয়ে। কিছু মানুষকে চাকরির বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু যে পরিমাণ মানুষ আবদার নিয়ে আসত, সে পরিমাণে সহযোগিতা করতে পারতেন না, কারণ অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাইলেই লোক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখান থেকেই ভাবনা আসে কীভাবে বেশিসংখ্যক মানুষকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। একই সময়ে চাকরিতে থাকা অবস্থায়ই আইইএলটিএস কোর্সটিও সম্পন্ন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য আবেদন করেন। ভিসা হয় না, কারণ তার পর্যাপ্ত ব্যাংকিং লেনদেন ছিল না।

প্রথমবার স্বপ্নভঙ্গ হলেও হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি। এবার ২০১৪ সালে চাকরি ছেড়ে সাভারের যুব উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন। কৃষির ওপর চার মাসের প্রশিক্ষণে হয়েছেন দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে প্রশিক্ষণ শেষে বন্ধুদের আর্থিক সহযোগিতায় সাভারের পাথালিয়া ইউনিয়নের ঘুঘুদিয়া এলাকায় শুরু করেন মুরগীর ফার্ম।

তিন মাসের মাথায় বন্ধ করে দিতে হয় সিন্ডিকেট সংক্রান্ত জটিলতার কারণে। একই জায়গায় শুরু করেন মাশরুম চাষ। বেশ ভালো উৎপাদন হলেও বিক্রি করার বাজার না থাকায় আবারো হোঁচট খেলেন। তবু দমে যাননি, নতুন করে স্বপ্ন দেখেন নতুন কিছু করার।

আবার চাকরিতে যোগ দেন একটি কুটির শিল্প কারখানায়। তবে এবার চাকরি করার উদ্দেশ্যে নয়, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। ২০১৮ সালে তিন মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন সাভারের ভাটপাড়া এলাকায় এবং মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে শুরু করেন হোগলা পাতার কারুপণ্য তৈরির কাজ।

আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি কারুপণ্য তৈরির মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ নিয়ে পরিবেশ প্রকৃতির প্রতি মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করে চলেছেন মাফুজুল গণি। হোগলা পাতা থেকে নিত্যব্যবহার্য এসব নান্দনিক পণ্য তৈরি করে চলেছেন তারই প্রতিষ্ঠান গণি ক্রিয়েশনের মাধ্যমে।

মাফুজুল গণি জানান, বর্তমানে আমাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত দেশের নানা প্রান্তের দুই হাজারের বেশি নারী-পুরুষ। হোগলা পাতা থেকে তৈরি দড়ি আসে দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে। মাত্র একটি রুমে শুরু হওয়া কারখানাটির ব্যাপ্তি এখন চারটি শেডে। এখানকার কারুশিল্পীদের হাতের কারুকার্যে তৈরি হচ্ছে বাসকেট, হ্যাংগিং, ঝুড়ি, টপ, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, নার্সারি পট, মাদুল, সোফাসেট, ফুলদানিসহ প্রায় ২০০ প্রকারের পণ্যসামগ্রী।

গল্পের এক পর্যায়ে মাফুজুল গণির গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে ওঠে। সফলতার আগে নিদারুণ কষ্টের কথা মনে পড়ে যায় বারবার। সে সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ কাজ শুরু করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অর্থাভাবে দিন কেটেছে। শুরুর দিকে মিরপুরের ঝুটপট্টি থেকে সুতা সংগ্রহ করতাম। খরচ কমানোর জন্য মাথায় করে সুতা বয়ে আনতাম। সংকোচে থাকতাম বন্ধু বা পরিচিতজনরা দেখে ফেলে কিনা! এক আত্মীয় কারখানার জায়গা ভাড়া দেবেন বলে কথা দিয়েও পরে আর দেননি। স্থানীয় এক বৃদ্ধা এগিয়ে আসেন তখন। এমন বহু বিষয় পাড়ি দিয়ে আজ আমি এখানে।

একটা সময় পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বায়িং হাউজ আর হস্তশিল্পের রফতানিকারকদের পণ্য তৈরির কাজই করতেন। সম্প্রতি নিজেই রফতানিকারকের খাতায় নাম তুলেছেন। ফ্রান্সে গেছে পাঁচটি আইটেমের একটি চালান, পণ্য গেছে জার্মানিতেও। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ারদের সঙ্গে আলোচনা চলছে রফতানির ব্যাপারে। এরই মধ্যে পেয়েছেন বিশ্বব্যাংকের এক্সপোর্ট রেডিনেস ফান্ডের (ইআরএফ) অনুমোদন, যা তাকে আরো দায়িত্বশীল উদ্যমী করে তুলেছে। ২০২২ সালে পেয়েছেন জাতীয় এসএমই ফাউন্ডেশনের বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার।

গণি ক্রিয়েশনের পুরো কারখানা চলছে নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তথা সোলারের মাধ্যমে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এসএমই ফাউন্ডেশনের পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে গড়েছেন 'গণি ফাউন্ডেশন' এছাড়া সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) তে শারীরিক অক্ষমদের জন্য গণি ক্রিয়েশনের পক্ষ থেকে দেয়া হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ। সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের (সিজেডএম) সঙ্গেও দেশের বিভিন্ন জেলায় দুস্থ নারীদের হস্তজাত পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে গণি ক্রিয়েশন।

সাফল্যের পথ ধরে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, কিন্তু সময় স্বল্পতা ভিসা জটিলতার কারণে অংশ নিতে পারেননি। নিয়ে সাময়িকভাবে কষ্ট পেলেও মোটেই হতাশ নন বরং আগামী মেলায় অংশ নিতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তার প্রতিষ্ঠিত কারুপণ্যের প্রতিষ্ঠান গণি ক্রিয়েশনে বেতনভুক্ত কর্মী প্রায় ২০০ জন। প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ কর্মীই নারী। কর্মীদের জন্য আছে নানা সুযোগ-সুবিধা। গণি ক্রিয়েশনের কর্মীদের রয়েছে স্বাস্থ্যবীমা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকার কারণে এখানকার কর্মী তাদের পরিবারের সদস্যদের রয়েছে চিকিৎসা সুবিধা। পাশাপাশি এখানকার নিরক্ষর কর্মীদের জন্য আগামীতে দৈনিক এক ঘণ্টার স্কুল খোলার চেষ্টাও চালাচ্ছেন। নতুন যারা আসেন কাজ শিখতে, তাদের জন্য রয়েছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

গণি ক্রিয়েশনে কাজ করেন রানা প্লাজায় আহত কয়েকজন নারী শ্রমিক। কথা হয় এমনই একজনের সঙ্গে নাম সুরাইয়া, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আটকা পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ঠিকই, তবে আগের মতো আর গায়ে জোর পান না। অবস্থায় সবাই কাজে নিতে চায় না। পরে গণি ক্রিয়েশনের খবর পেয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখানে কাজ শুরু করেন। সুরাইয়া বলেন, এখানে কাজ করতে পেরে আমি আমার মতো অন্য যারা আছেন সবাই আনন্দিত। এখানকার কাজের পরিবেশ সুন্দর। সবাই অনেক ভালো ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে।

পরিবেশবান্ধব পণ্য বানিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি শ্রমবান্ধব কর্মপরিবেশও তৈরি করতে চান উদ্যোক্তা। ভবিষ্যতে নিজেদের জায়গায় কারখানা স্থাপন করে আরো বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।

টিডিএম/এএম