ঢাকা,  বুধবার
০৯ জুলাই ২০২৫

The Daily Messenger

ফার্নিচার গ্রামে মাসে বিক্রি হয় ৫ কোটি টাকার ফার্নিচার

আদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ফার্নিচার গ্রামে মাসে বিক্রি হয় ৫ কোটি টাকার ফার্নিচার

ছবি : টিডিএম

কাঠের আসবাবপত্র ঘুগ ঘুগ ধরে কমবেশি সবার প্রিয়। বর্তমান যুগে শহর গ্রাম বলে কোন কথা নেই। শৌখিন মানুষদের ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র। এসকল আসবাবপত্র যারা তৈরী করেন তাদের বলা হয় কাঠ মিস্ত্রি বা সূঁতার। এঁদের তৈরি করা আসবাবপত্র ব্যবহার করেই প্রতিপত্তি জাহির করে সকলেই।

একারণেই যমুনা তীরে অবস্থিত সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার ছালাভরা গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ মানুষ পেশার সাথে জড়িত থাকায় মানুষের মুখে মুখে গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছেফার্নিচার গ্রামহিসেবে। এই ফার্নিচার গ্রামে হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এতে মাসে প্রায় কোটি টাকার ফার্নিচার বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে কাঁচামালসহ দ্রব্যমুলের উর্ধগতির বাজারে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি কর্মমুখর থাকে পুরো ফার্নিচার গ্রামটি। গ্রামের পাশ দিয়ে গেলেই শোনা যাবে কাঠের খট খট শব্দ। কেউ কাঠ কাটছেন, কেউ জোড়া দিচ্ছেন, কেউবা এগুলোতে ফুটিয়ে তুলছেন দৃষ্টিনন্দন নকশা। কোথাও আবার চলছে বার্নিশের কাজ। ঘরের গৃহিণী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পড়য়া শিক্ষার্থী পর্যন্ত এসব কাজে পারদর্শী। এই পেশায় স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেকের ভাগ্যবদল হয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, ধীর্ঘদিন ধরে ফার্নিচার গ্রামের অধিংকাশ মানুষ এই কাজে জড়িত। এই গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন ছোট-বড় দুই শতাধিক কারখানা। এই কারখানাগুলোতে জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে প্রায় হাজার মানুষের। এই গ্রামের ফার্নিচারগুলো যাচ্ছে দেশের ১৫টি জেলায়। এখানে তৈরি হয় আলমারি, শোকেস, ড্রেসিং টেবিল, খাট, পড়ার টেবিল, সোফাসেটসহ নানা রকমের আসবাবপত্র।

সাশ্রয়ী মূল্যে এসব আসবাবপত্র কিনতে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নেত্রকোনা, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা এখানে আসেন। প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকার আসবাবপত্র বিক্রি হয় ফার্নিচার গ্রামে।

ফার্নিচারের কারিগর জহুরুল মিয়া বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই পেশায় জড়িত ছিলেন। বর্তমানে আমরাও এই কাজ করি। আগে টাঙ্গাইলে কাজ করতাম। এখন বাড়ির কাছেই কারখানা হয়েছে। এখানে তিন বছর ধরে কাজ করছি। দুর-দুরান্ত থেকে পাইকাররা এখানে এসে ফার্নিচার তৈরীর অর্ডার দেন। এখান থেকে সাশ্রয়ী দামে ফার্নিচার কিনে নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করেন।

আরেক কাঠ মিস্ত্রী আলী হোসেন বলেন, কম দামে ভালো মানের ফার্নিচার তৈরি হয় এখানে। এগুলোর চাহিদাও বেশি। খাট-সোফা, চেয়ার-টেবিল আলনা থেকে শুরু করে সব ধরনের ফার্নিচার তৈরী করে এই গ্রামের কারিগররা। চাহিদা মতো অর্ডার দিয়ে এগুলো বানিয়ে নিয়ে যান বিভিন্ন পাইকারা। প্রতিটি পরিবার মাসে কম করে হলেও তিন লাখ টাকার ফার্নিচার বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে মাসে কোটি টাকার ফার্নিচার কেনাবেচা হয়।

রং মিস্ত্রি আশিক বলেন, আমি সরকারি মনসুর আলী কলেজের একাদশ শ্রেণিতে লেখাপড়া করি। এর পাশাপাশি রং মিস্ত্রির কাজ করি। ওস্তাদের সঙ্গে কাজ করে দিনে ৪০০ টাকা মজুরী পায়। এই টাকায় সংসারে বাড়তি জোড়ার হচ্ছে।

ফার্নিচারের মালিক হারুন শেখ বলেন, সর্বনি¤œ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা মূল্যের আসবাবপত্র তৈরি হয় এই কারখানায়। আসবাবপত্র তৈরিতে কাঠের জোগান আসে টাঙ্গাইল, নওগাঁ ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। এই গ্রামের কারখানাগুলোর তেমন কোন নাম নেই। এই কারখানাগুলোয় প্রায় হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কারিগরেরা কিছু নকশা হাতে তৈরি করে। আর কিছু নকশা কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে তৈরি করা হয়।

যন্ত্রে তৈরি নকশায় একজন গ্রাফিক ডিজাইনার প্রয়োজন। ধরনের নকশার চাহিদাও একটু বেশি। নকশা তৈরির পরের কাজ করেন রং মিস্ত্রি। তিনি ঘষে পলিশের পর রং করে বিক্রির উপযোগী করেন। আশপাশের গ্রামেও কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সরকার ঋণের ব্যবস্থা করলে অনেকে ব্যবসা বড় করতে পারবে।

কবির হোসেন নামের এক ফার্নিচার ব্যবসায়ী বলেন, আসবাবপত্র অনেকেই তৈরি করতে পারেন। কিন্তু কাঠের ওপর কারুকাজ করা সহজ কাজ নয়। যারা আসবাবপত্রে কারুকাজ করেন তাদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তাদের বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে দোকানে রাখা কাজ করাতে হয়।

ছালাভরা গ্রামের প্রথম ফার্নিচার ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকা থেকে এসে আমি গ্রামে একটি কারখানা শুরু করি। সেই থেকে এই গ্রামের ফার্নিচার তৈরি কারখানার কাজ শুরু হয়। এখন আমার কারখানায় ৫০-৬০ জন শ্রমিক রয়েছে। এখন সবাই আমাদের এই গ্রামকেফার্নিচার গ্রামবলেই চেনে।

শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, আমার দেখায় অনেক কারখানা তৈরী হয়েছে। তাই সহজ শর্তে কম সুদে সরকারি ভাবে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে আরও বেশি সংখ্যক উদ্যোক্তা শিল্পে যুক্ত হবেন। পাশাপাশি বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, স্বপ্ল সুদসহ যে ধরনের সহযোগিতা চায় এই কাঠ ব্যবসায়ীরা। আমরা তাদের সকল সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছি।

ব্যাপারে কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় সরকার বলেন, কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কারখানার প্রসারে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মসংস্থান পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে ওই গ্রামের ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে পারবেন। প্রয়োজনে তাঁদের উন্নত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হবে।

টিডিএম/এএম