ঢাকা,  শনিবার
২৭ জুলাই ২০২৪

The Daily Messenger

প্রকাশ্যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা, পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৭:৩৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

প্রকাশ্যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা, পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড

ছবি : মেসেঞ্জার

পরকীয়ার জেরে প্রকাশ্যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা মামলার একমাত্র আসামি বরখাস্ত হওয়া পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সৌমেন রায়কে (৩৪) মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সাথে এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছে আদালত।

রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিকালের দিকে জেলা দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রুহুল আমীন রায় দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অনুপ কুমার নন্দী।

আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারক রায় ঘোষণা করেন। সৌমেন রায় প্রায় এক বছর তিনমাস আগে হাইকোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। তার খোঁজ জানেন না কেউ। পরপর বেশ কয়েকবার হাজিরা না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

ভারতে পালিয়েছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে মামলায় শাস্তি থেকে রেহাই পেতে সৌমেন রায় দেশ ছেড়েছেন বলে অভিযোগ মামলার বাদী, আইনজীবী এলাকাবাসীর। আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করা হয়।

এ বিষয়ে আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অনুপ কুমার নন্দী  বলেন, তিনজনকে গুলি করে হত্যা মামলার একমাত্র আসামি সৌমেনমে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। একই সাথে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আসামি পলাতক রয়েছে।

আসামি সৌমেন রায় মাগুরা সদর উপজেলার কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের আসবা গ্রামের সুনীল রায়ের ছেলে। তিনি সর্বশেষ খুলনার ফুলতলা থানায় এএসআই হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মামলার তথ্য আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৩ জুন কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড় এলাকার নাজ ম্যানশন মার্কেটের বিকাশের দোকানের সামনে পরকীয়ার জেরে স্ত্রী আসমা খাতুন (২৫), আসমার ছেলে রবিন () এবং আসমার পরকীয়া প্রেমিক শাকিলকে (২৮) সরকারি অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন এএসআই সৌমেন রায়।

ঘটনায় পুলিশ তাকে ঘটনাস্থল থেকে সার্ভিস রিভলভার, গুলি ম্যাগাজিনসহ আটক করে। সেদিন বিকেলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। একই দিন রাতে এএসআই সৌমেন রায়কে একমাত্র আসামি করে হত্যা মামলা করেন নিহত আসমা খাতুনের মা হাসিনা বেগম। পরদিন ১৪ জুন বিকেলে কুষ্টিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. এনামুল হকের আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সৌমেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশিকান্ত সরকার তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ২০২২ সালের নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন সৌমেন রায়। এরপর কুষ্টিয়া আদালতে বারবার আত্মসমর্পণের দিন ধার্য থাকলেও তিনি আত্মসমর্পণ করেননি।

আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সাত মাস পেরিয়ে গেলেও লাপাত্তা সৌমেন। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।

আরও জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৩ জুন আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্রসহ সৌমেন রায়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন তিনি।

পরকীয়ার জেরে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। এমতাবস্থায় ২০২২ সালের নভেম্বর আসামি সৌমেন হাইকোর্টে থেকে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হন। এরপর থেকেই তিনি লাপাত্তা।

বেশ কয়েকবার তাকে কুষ্টিয়ার জেলা দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিনের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি একবারও আত্মসমর্পণ করেননি। নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

বিষয়ে পলাতক সৌমেনের পরিবারের লোকজনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় লোকজন জানান, তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনার পর সৌমেনকে এলাকায় দেখা যায়নি কখনো। তবে গুঞ্জন শোনা যায় সৌমেন জামিন নিয়ে ভারতে পালিয়েছেন।

মামলার বাদী হাসিনা বেগম বলেন, আমার মেয়ে, তার ছেলে রবিন শাকিল নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে সৌমেন। সে হাইকোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে ভারতে পালিয়েছে। এতো দিনেও তাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।

বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে শুনেছি সে ভারতে পালিয়েছে। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের একমাত্র আসামিকে জামিন দেওয়ায় আমি হতাশ। প্রকাশ্যে তিনজনকে হত্যা মামলার একমাত্র আসামির জামিন হলো কীভাবে। সৌমেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় আমি খুশি। তার মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হোক, দ্রুত গ্রেপ্তার করা হোক।

চাঞ্চল্যকর তিনজনকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি সৌমেন রায় জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, জামিন পাওয়ার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। কিন্তু চাঞ্চল্যকর ত্রিপুল হত্যা মামলায় স্বীকারোক্তি দেওয়ার পরও আসামির জামিন পাওয়াটা অস্বাভাবিক। এমন চাঞ্চল্যকর মামলার আসামির জামিনের বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত।

অন্যদিকে জামিন পাওয়ার পর আসামি যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি থাকতে হবে। খুন করার পর আসামি গ্রেপ্তার হন, জেলে ঢোকেন। কিন্তু জামিনের পর জেল থেকে বেরিয়ে যদি নিখোঁজ হয়ে যায় বা দেশ থেকে পালিয়ে যায় বা শাস্তি থেকে কোনো প্রকার রেহাই পায় তাহলে ধরনের অপরাধের মাত্রা সমাজে বাড়তে পারে। জামিন প্রাপ্ত আসামিকে আদালতে হাজির করার জন্য মুচলেকায় স্বাক্ষর করা জামিনদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, কুমারখালী থানায় দায়িত্বে থাকার সময় এএসআই সৌমেনের সঙ্গে একটি মামলাকে কেন্দ্র করে আসমার পরিচয় হয়। পরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সময় সৌমেন তার নাম মো. সুমন হোসেন রাখেন এবং সুমন নামেই মুসলিম বিধান মতে আসমাকে বিয়ে করেন। সৌমেন আসমার তৃতীয় স্বামী ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই কুষ্টিয়ার আড়ুয়াপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় তারা বাস করছিলেন।

এএসআই সৌমেন খুলনার ফুলতলা থানায় বদলি হওয়ার পর থেকেই বিকাশকর্মী শাকিলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান আসমা। সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি সৌমেন। আসমার প্রতি ক্ষোভ জমিয়ে রাখেন মনে। সেই ক্ষোভ থেকেই দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন সৌমেন।

নিহতরা হলেন- এএসআই সৌমেনের স্ত্রী আসমা, আসমার দ্বিতীয় স্বামীর ছেলে রবিন এবং পরকীয়া প্রেমিক শাকিল।

সৌমেন রায় ২০১৫ সালে কনস্টেবল থেকে এএসআই পদে উন্নীত হন। পরে ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় যোগ দেন। সেখান থেকে মিরপুর থানার হালসা ক্যাম্প, বাগেরহাট থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ খুলনার ফুলতলা থানায় কর্মরত ছিলেন।

মেসেঞ্জার/রাজু/আপেল