ঢাকা,  সোমবার
২৩ জুন ২০২৫

The Daily Messenger

লক্ষ্মীপুরে বাড়ছে বন্যার পানি, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ

জহিরুল ইসলাম শিবলু, লক্ষ্মীপুর

প্রকাশিত: ১৯:১৭, ২৪ আগস্ট ২০২৪

লক্ষ্মীপুরে বাড়ছে বন্যার পানি, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ

ছবি : মেসেঞ্জার

লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে পানি, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) থেকে বৃষ্টি না হলেও বাড়ছে পানি। পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। এতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছে স্থানীয় লোকজন।

লক্ষ্মীপুরে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে জেলার প্রায় বেশিরভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবে গত দুই ধরে বৃষ্টিপাত না হলেও পানির উচ্চতা বাড়ছে।

জেলা শহরের পৌর এলাকা, সদর উপজেলার মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, উত্তর জয়পুর, দত্তপাড়া, চরশাহী, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, বাঙ্গাখা, পার্বতীনগর, টুমচর ইউনিয়ন এবং জেলার কমলনগর, রামগতি, রায়পুর রামগঞ্জ উপজেলাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ জোয়ারের পানিতে জেলার মেঘনা নদীসহ খাল-বিলের পানি বেড়ে গেছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়ন এখন পানিতে ডুবে আছে।

যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু পানি আর পানি। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ পানিতে ডুবে আছে। কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন লাখো মানুষ।

লক্ষ্মীপুর পৌর আইডিয়েল কলেজ স্থানীয় একটি মহিলা মাদরাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আশ্রয় নিয়েছে ২৫০টি পরিবার। তাদের সবার বাড়ি পৌরসভার নম্বর এবং ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে।

গৃহবধূ রেখা বেগম জানান, তাঁদের ঘরে ভেতর হাঁটু সমান পানি। খাটের ওপরও পানি উঠে গেছে। তাই পরিবারের চার সদস্যদের নিয়ে তিনি উঠেছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের খালপাড় এলাকায়।

আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে কুলসুম বেগম, মরিয়ম আমেনা বেগম বলেন, আমাদের সব ডুবে গেছে। ঘরের মধ্যে হাঁটুর ওপর পানি। থাকার মতো অবস্থা নাই। পরিবারের শিশু সন্তানদের নিয়ে ভয়ে ছিলাম। রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আসছি।

তারা আরও বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে কেউ কেউ শুকনো খাবার দিয়ে যাচ্ছে। তবে চাল না থাকায় ভাত রান্নার ব্যবস্থা ছিল না। শুকনো খাবার খেয়েই কোনোমতে দিন পার করছি।

পৌর এলাকার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হারুন বলেন, ঘরের ভেতরে হাঁটু পানি। ঘরের সামনে কোমর পানি। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। আমাদের আশেপাশের প্রায় প্রত্যেকের ঘরে পানি উঠে গেছে। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু দিন দিন পানি বাড়ছে।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের যাদৈয়া গ্রামের বাসিন্দা আরমান হোসেন লিয়াকত আলী বলেন, বসতঘরের সামনে হাঁটু পানি। ঘরে এখনও ঢুকেনি। তবে যেভাবে পানির উচ্চতা বাড়ছে, যে কোনো সময় ঘরে পানি ঢুকতে পারে। বাড়ির আশপাশে সাপের উপদ্রব্য বেড়েছে। শিশু সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কে আছি।

তারা আরও জানায়, তাদের আশপাশের অনেক বসতঘরে পানি উঠে গেছে। তারা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। রান্নার চুলো পানির নিচে তলিয়ে থাকায় খাবারের যোগান দিতে পারছেন না তারা। সব মিলিয়ে মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

চন্দ্রগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সুমন রাজু বলেন, চন্দ্রগঞ্জ এবং উত্তর জয়পুরসহ আশপাশের গ্রামীণ জনপদ তলিয়ে গেছে। কারো ঘরে পানি উঠেছে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।

এদিকে টানা পাঁচ দিনের ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের প্রায় ৪০ হাজার পুকুর ডুবে চাষের প্রায় সব মাছ ভেসে গেছে। এতে জেলায় মৎস্য খাতে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অপরদিকে জলাবদ্ধতার কারণে অনেক স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি হেলে পড়ায় তারে গাছ উপড়ে পড়ার কারণে অনেক স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আসাদুজ্জামান খান বলেন, অনেক গ্রাহক বিদ্যুৎহীন আছেন। গ্রাহকের নিরাপত্তার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। চার-পাঁচ দিন ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যা সাময়িক জানিয়ে তিনি বলেন, পানি কমে গেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নদীতে ভাটা এলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সব কটি স্লুইচ গেট খুলে দেওয়া হয়। আবার জোয়ারের সময় গেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক তাঁদের কর্মীরা পর্যবেক্ষণে আছেন। এখনো মেঘনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এক-দুই দিনের মধ্যে পানি ধীরে ধীরে কমতে পারে।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুর্গত মানুষদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।