ছবি : মেসেঞ্জার
স্বৈরাচারের পতন ও খুনি হাসিনার পদত্যাগের জন্য ছাত্র আন্দোলনে যোগাযোগ দিয়ে লক্ষ্মীপুরে টিপুর গুলিতে আহত হয়ে এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন ছাত্র-আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সুজন। বর্তমানে সুজনের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্ত অভাবের সংসরে সুজনের পরিবারে পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই সুজনের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগীতা চেয়েছে তার পরিবার।
জানা যায়, (৪ আগস্ট) লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন খালেদ মাহমুদ সুজন (১৯)। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৯টি ছররা গুলির স্প্রিন্টার এবং একটি তাজা বুলেট বিদ্ধ হয়। তাজা বুলেটটি লিভারে গিয়ে বিদ্ধ হয়। আর ছররা গুলিগুলো দুই হাতে, ঘাড়ে, বুকে কানের পাশে লাগে।
প্রথম যাত্রার সুজন বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রায় দেড় মাস চিকিৎসা নিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও এখনও সুস্থ জীবনে ফেরেননি। কারণ, সুজনের শরীরে এখনও ৮টি ছররা গুলি রয়েছে। তিন মাস ধরে এসব গুলি শরীরে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। এতে তার বাম অংশ প্যারালাইজড হওয়ার পথে। তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হচ্ছে সুজনকে। অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলাও করতে পারছেন না তিনি।
দেশের কোনো হাসপাতালে তার আর চিকিৎসা করানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সুস্থ জীবনে ফেরা নিয়ে শঙ্কা সুজনের। প্রাণ নিয়েও সংশয় রয়েছে তার। তবে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারলে হয়ত বেঁচে যাবেন তিনি। কিন্তু অভাবের সংসারে পেটে ভাতের জোগান দিতেও যেন হিমশিম খেতে হচ্ছে সুজনের পরিবারের সদস্যদের।
সুজন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের ৪নম্বর ওয়ার্ডের রসুলগঞ্জ বাজার সংলগ্ন তাজল ইসলাম ভূঁইয়া বাড়ির শাহীন কাদেরের মেজো ছেলে। সুজনের আরও দুইভাই আছে। বাবা শাহীন কাদের ও বড় ভাই সোহান বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ছোটভাই শিহাব ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন সুজন।
কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘরবন্দি সুজনের পরিবারে আয়ের এখন কোনো উৎস নেই। আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির লোকজনের সহায়তায় আপাতত চলছে সুজনদের সংসার।
(৪ আগস্ট) লক্ষ্মীপুর শহরের তমিজ মার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন খালেদ মাহমুদ সুজন। ওইদিন শহরের মাদাম ব্রিজ এলাকায় ও নিজ বাসভবনের ছাদ থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক যুবলীগ নেতা এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু ও তার সহযোগীরা। এতে চার শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, তিন শতাধিক গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় ৫০০ ছাত্র-জনতা।
সুজন জানায়, তিনি যখন ৯ম শ্রেণিতে পড়েন তখন থেকেই টুকটাক ব্যবসা করে পরিবারের ভরণপোষণ চালাতেন। ২০২৩ সালে তিনি লক্ষ্মীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের আওতায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। লেখাপড়ার পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর শহরের পুরাতন আদালত সড়কে ‘মা ফার্নিচার হাউস’ নামীয় একটি ক্রোকারিজ দোকান চালাতেন। তা দিয়েই চলতো তাদের সংসার। কিন্তু এখন তার দোকান বন্ধ।
তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে অংশ নিতাম। (৪ আগস্ট) সকালে আন্দোলন শুরু হলে আমি মাদাম এলাকা থেকে যোগ দিই। সেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। এরপর এদিন শহরের তমিজ মার্কেটে থাকা সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান টিপুর বাসভবনের ছাদ থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আমি গুলিবিদ্ধ হই। টিপু সরাসরি আমাকে গুলি করে। বেশকিছু ছররা গুলি আমার শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। একটি তাজা গুলিও আমার বুকে লাগে। আমি লুটিয়ে পড়ি। আমার সঙ্গে থাকা আন্দোলনরত আমার ভাইয়েরা আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সুজনের আত্মীয় মো. মোবারক হোসেন বলেন, গুলিবিদ্ধ সুজনকে হাসপাতালে দেখার মতো পরিবারের কেউ ছিল না। তাই আমি সদর হাসপাতালে ছুটে যাই। কিন্তু সদর হাসপাতালে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হামলার আশঙ্কায় সুজনকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে নোয়াখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওই হাসপাতালটি গুলিবিদ্ধ সুজনকে ভর্তি করেনি। পরে ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে অপারেশনের মাধ্যমে তার লিভার থেকে পিতলের বড় একটি গুলি (তাজা গুলি) বের করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু তার শরীরে আরও ৮টি গুলি রয়ে গেছে। দেশের কোন হাসপাতালে অপারেশন করেও গুলিগুলো বের করা সম্ভব নয় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছে। অপারেশনে সে মারা যেতে পারে। তাই বিদেশে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
সুজন বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ দিন থাকার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সিএমএইচ হাসপাতালে অপারেশন করে আমার হাতের একটি গুলি বের করা হয়। সিএমএইচে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আমার শরীরে বর্তমানে যে ৮টি গুলি রয়েছে সেগুলো তারা বের করতে পারবেন না। বিদেশে চিকিৎসার মাধ্যমে তা বের করা যেতে পারে। ৩০দিন পর আমি সিএমএইচ থেকে বাড়ি চলে আসি।
তিনি বলেন, আমার ডান হাতে তিনটি, ঘাড়ের ভেতরে একটি, বুকের ভেতরে দুটি, কানের নিচে একটি ছররা গুলিসহ এখনো ৮টি গুলি রয়ে গেছে। এগুলো নিয়েই আমাকে থাকতে হচ্ছে। সুজন বলেন, আমার ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাড়ি ও গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ চিকিৎসার জন্য সাহায্য করেছে।
সংসারের অভাব অনটনের কথা জানিয়ে সুজন আরও বলেন, এখন একদিকে আমার উপার্জন বন্ধ, অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু আমাকে দেখার মতো কেউ নেই। কোনো টাকা পয়সা নেই। সংসার চলছে না। ৫ সদস্যের পরিবারের বাবা এবং বড় ভাই প্রতিবন্ধী। কোনো কাজ ও উপার্জন করতে পারে না। ছোট ভাই ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। তার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এখন আমি কি চিকিৎসার ব্যয় চালাব, নাকি সংসার চালাব? স্বাভাবিক জীবনে কখন ফিরতে পারবো কি-না জানি না। এক কথায় আমার এবং আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ পুরো অন্ধকার।
সুজন আরও বলেন, ওইদিনের ঘটনায় আমাদের বাড়ির আশপাশের আরও প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন আহত হয়েছেন। কিন্তু আমার অবস্থা সবার থেকে মারাত্মক। আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত কোন পদক্ষেপ নিবেন কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে সুজন বলেন, এখন আমার প্রধান চাহিদা চিকিৎসা ও পরিবারের ৩ বেলা খাবার। মামলা করবো কিনা জানি না। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছি। মৃত্যুও হতে পারত। দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার। আশা করি আমরা যারা গুরুতর হতাহত হয়েছি, তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে।
সুজনের চাচা কফিল উদ্দিন বলেন, সুজনদের অভাবের সংসার। তারা বাবা-ভাই প্রতিবন্ধী। সুজনই ছোটবেলা থেকে সংসার চালিয়ে আসছে। কিন্তু এখন তার সে অবস্থা নেই। তার নিজের চিকিৎসা খরচও চালানোর মতো সাধ্য নেই। আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির লোকজন আপাতত সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু সবসময় তো সহযোগিতা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই সুজনের সুচিকিৎসার এবং তার পরিবারের দিকে সরকারের নজরদারি দেওয়া উচিত।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এ কে আজাদ জানান, সুজনের দেহের প্রতিটি গুলি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কোনো কারণে ইনফেকশন দেখা দিলে নিশ্চিত প্রাণহানি ঘটতে পারে। দ্রুত তার শরীর থেকে গুলিগুলো বের করা প্রয়োজন। এজন্য হয়তো বিদেশে নেওয়া লাগতে পারে।
জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হচ্ছে। আমরা তাদের পরিবারের পাশে আছি।
মেসেঞ্জার/শিবলু/তারেক