
ছবি : মেসেঞ্জার
মৌসুমের প্রথম থেকে জাল নৌকা নিয়ে নদীতে নেমেছেন জেলেরা। কয়েকদিন মাছও শিকার করেন। মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরির জন্য প্রস্তুত করেন মাঠ। এই পেশার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা নিজেদের কর্মে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। জেলে, মহাজন ও শ্রমিকের হাঁক ডাকে ঘাটগুলোতে বিরাজ করছিল উৎসবের আমেজ। একটি সিদ্বান্তে হঠাৎ বদলে যায় এই চিত্র। গত সপ্তাহ থেকে নদীতে বেহুন্দী জালদিয়ে মাছ শিকারে বাধা দেন প্রশাসন। মৎস অফিসের অধিনে যৌথবাহিনী পুড়িয়ে পেলছেন জেলেদের এই জাল। এতে আর্থিক ভাবেনি:স্ব হয়ে পড়ছেন এই পেশার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা। সারি সারি নৌকা খালে বেঁধে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে নোয়াখালী হাতিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার জেলে।
হাতিয়ার চারপাশে মেঘনা নদী। এতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে এই উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক জেলে। এরমধ্যে বেশিরভাগ জেলে জড়িত ইলিশ ও ছেউয়া মাছ শিকারে। উপজেলার জঙ্গলিয়া, সূর্যমূর্খী, কাজিরবাজার, কাদিরা সূইজ, বন্দরটিলা, শতফুল, নামার বাজারসহ ২০টি ঘাটে প্রায় ৫০ হাজার জেলে ছেউয়া মাছ ধরা ও শুটকি তৈরির সাথে জড়িত। শীতের প্রথম থেকে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ছেউয়া মাছের এই মৌসুম চলে মার্চ মাস পর্যন্ত। ইলিশের তুলনায় ছেউয়া ধরায় পুজি কম লাগায় অনেকে বংশানুক্রমে এই মাছ শিকার করে জিবীকা নির্বাহ করে। প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও জেলেরা ছেউয়া মাছ শিকার করতে জাল নৌকা ও প্রয়োজনীয় আবাপত্র নিয়ে নদীতে নামে। আশাছিল অন্যান্য বছরের ন্যায় এই বছরও ছেউয়া মাছের শুটকি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করবে। কিন্তু সরকারিভাবে দেওয়া বাধায় সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। এই অঞ্চলে জেলে পল্লীতে নেমে এসেছে হাহাকার।
শতফুল এলাকার জেলে আবদুল মালেক বলেন, ছেউয়া মাছ ধরার মৌসুম শুরু হয়েছে এক মাস আগ থেকে। অনেক ঘাটে মাছের বেছাকিনা এবং শুটকি করা ও শুরু করেছে। কিন্তু লাভের মূখ দেখার আগেই দেওয়া হয় বাঁধা। এখন জাল নৌকা নিয়ে ঘাটে অলস সময় পার করতে হচ্ছে আমাদের। দৈনন্দিন খাওয়ার জোগানে হিমশিত খেতে হচ্ছে। মৌসুম শুরুর আগেই এই সিদ্বান্ত জানতে পারলে এত বড় ক্ষতির মধ্যে আমাদের পড়তে হতো না।
একই এলাকার জেলে আতাজল হক বলেন, আমরা হাতিয়ার নদী ভাঙা বাস্তহারা পরিবার। নিঝুমদ্বীপে এসে কোন রকম মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়েছে। এখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় কোন কল কারখানা ও নাই যে আমরা চাকরি বাকরি করে জীবন যাপন করবো। আমাদের একেকজনের পরিবারে ৭-৮জন সদস্য। নদীর সাথে আমাদের যোগাযোগ। নদীতে মাছ ধরে কিছু পেলে বাচ্ছা-কাচ্ছা নিয়ে খাই। এখন চেউমা ধরার সময়। ঋণ নিয়ে জাল কিনে দোকানপাট থেকে বাকিতে যাবতীয় বাজার সাজার করে নৌকা নিয়ে নদিতে নেমেছি। কিন্তু প্রশাসন আমাদেরকে মাছ ধরতে দিচ্ছেনা। সিজনও শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি মাছ ধরতে না পারি তাহলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।
সম্প্রতি সরকারি এই সিদ্বান্ত পরিবর্তন করার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে নিঝুম দ্বীপের জেলেরা। তাতে জেলেরা জানান, হাতিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের নিঝুমদ্বীপসহ চারটি ইউনিয়নে জেলেরা ছেউয়া মাছ বেশি ধরেন। এতে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ছেউয়া শুটকি বিক্রি করে আয় করে জেলেরা। কিন্তু এই ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলে বিশাল অর্থনৈতিক উপার্জন থেকে বঞ্চিত হবে জেলেরা। যার প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনমানে।
সাবেক ইউপি সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, তিন থেকে চার মাস নিঝুমদ্বীপে চেউমা মাছ ধরার মৌসুম। এই মৌসুমে অন্য কোন মাছের পোনা লাগে না। এই চেউয়া মাছ ধরে এখানকার জেলেরা পরিবার পরিজন নিয়ে কোন রকম জীবন অতিবাহিত হরে। গত বছর এখানে প্রায় ১৬ হাজার টন চেউয়া শুটকি উৎপন্ন হয়েছে এবং প্রায় ২০হাজার টন কাঁচা চেউয়া মাছ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়েছে। প্রতি টন শুটকি প্রায় ১লাখ টাকা এবং প্রতি টন কাঁচা চেউয়া মাছ ৫০হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়। যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে অনেক বড় অবদান রাখে। কিন্তু এবছর মাছ ধরতে না পারায় এতে প্রায় ৩শত কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছেন এখানকার জেলেরা।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফাহাদ হাসান বলেন, বেহুন্দী জাল ব্যবহার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। এই জাল ব্যবহার করে এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ছেউয়া মাছ আহরণ করেন জেলেরা। তাতে কাঁচা মাছ ও শুটকি বিক্রি করে কোটি টাকা আয় করেন জেলেরা। আমরা চেষ্ঠা করছি এই মাছ ধরতে বিকল্প কোন উপায় বের করা যায় কি-না। বিষয়টি আমি উর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে অবহিত করেছি।
মেসেঞ্জার/রাসেল/তুষার