
ছবি : মেসেঞ্জার
মাত্র ১৪ দিনের সংসার, এরপর দীর্ঘ ১৬ বছরের অপেক্ষা। সময়ের হিসাবে এক যুগেরও বেশি, কিন্তু মন থেকে কখনো হারিয়ে যাননি তিনি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন কেটেছে বেবী আক্তারের। স্বামী মোতাহার হোসেনের মুক্তির আশায় কেটেছে প্রতিটি মুহূর্ত। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় আটক সাবেক বিডিআর সদস্য মোতাহার জামিনে মুক্তি পেয়ে ফিরে এসেছেন পরিবারের কাছে। স্ত্রীর কাছে এটি যেন এক স্বপ্নের পুনর্মিলন।
***শুরুটা ছিল স্বাভাবিক, এরপর আসে অনিশ্চয়তা***
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের কচুবাড়ী জোতপাড়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে মোতাহার হোসেন মানিক। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল দেশের জন্য কাজ করার। সেই লক্ষ্যে বিডিআর-এ (বর্তমানে বিজিবি) চাকরি নেন। প্রশিক্ষণ শেষে কর্মজীবন শুরু হয় তার।
চাকরির ছয় মাসের মাথায় পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের মেয়ে বেবী আক্তারকে। দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয় ভালোবাসা ও স্বপ্নের এক নতুন অধ্যায় দিয়ে। কিন্তু সে সুখ ছিল স্বল্পস্থায়ী।
বিয়ের ১৪ দিনের মাথায় কর্মস্থলে ফিরে যান মোতাহার। স্ত্রীকে বাবা-মায়ের কাছে রেখে যান। তবে তিনি ভাবেননি যে এত দীর্ঘ সময় তার প্রিয় মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে।
***অপেক্ষার প্রহর শুরু***
২০০৯ সালে ঢাকার পিলখানায় ঘটে ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড। সেই ঘটনায় বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার হন মোতাহার হোসেন। স্ত্রীর কাছে খবর আসে, তিনি আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না। তখন থেকেই শুরু হয় এক কঠিন পরীক্ষা। পরিবার-পরিজনের অনেকে তখন বেবী আক্তারকে সংসার ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কেউ কেউ বলেন, "তোমার স্বামী তো আর ফিরবে না। এতদিন অপেক্ষার মানে কী?" কিন্তু বেবী আক্তার কানে তুললেন না এসব কথা। তিনি বিশ্বাস করতেন, একদিন না একদিন তার স্বামী ফিরে আসবেন।
***সংসারের দায়িত্ব একার কাঁধে***
স্বামী কারাগারে যাওয়ার পর বেবী আক্তারের সামনে আসে কঠিন বাস্তবতা। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মোতাহার। তার অনুপস্থিতিতে পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে বেবীর কাঁধে। এরই মধ্যে শ্বশুরও মারা যান। নিজের কষ্ট ভুলে শাশুড়ির দেখাশোনা করেছেন, সংসারের হাল ধরেছেন। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তিনি স্বামীকে ভুলে যাননি, অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন প্রতিদিন।
***অবশেষে স্বপ্নের পুনর্মিলন***
১৬ বছর পর, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর জামিনে মুক্তি পান মোতাহার হোসেন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি ছুটে যান তার প্রিয়জনদের কাছে। এতদিন পর স্বামীকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বেবী আক্তার।
স্বামীর মুক্তির পর আবেগাপ্লুত বেবী আক্তার বলেন, "অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, একদিন উনি ফিরে আসবেন। আজ সেই দিন এলো।"
মোতাহার হোসেনও স্ত্রীর ত্যাগে অভিভূত। তিনি বলেন, "এই ১৬ বছরে আমি শুধু আমার স্ত্রীর জন্য বেঁচে ছিলাম। জানতাম, সে অপেক্ষা করছে। আজ তাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমি সত্যিই ভাগ্যবান।"
***ভালোবাসার বিরল উদাহরণ***
বর্তমান সমাজে যেখানে সামান্য কারণেই দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যায়, সেখানে বেবী আক্তারের অপেক্ষা ও ভালোবাসা এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এ বিষয়ে সমাজের বিশিষ্টজনরা বলছেন, এই ঘটনা আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি উদাহরণ।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাইরুল ইসলাম বলেন, "মোতাহারের জীবনে যে দুর্যোগ নেমে এসেছিল, তা কাটিয়ে উঠতে আমরা তার পাশে থাকব। সরকারিভাবে তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।"
মেসেঞ্জার/আরিফ/তারেক