
ছবি : টিডিএম
আজ বিশ্ব পানি দিবস। সুপেয় পানির সংকট সমাধানের দাবি নিয়ে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি। কিন্তু বাংলাদেশের দক্ষিণ -পশ্চিম উপকূলের চারপাশে সুবিশাল জলরাশি থাকলেও খাওয়ার জন্য এক ফোঁটাও পানি নেই। সবই নোনা পানি। এ অঞ্চলের অনেক স্থানে গভীর নলকূপ থাকলেও পানিতে আয়রন ও লবণযুক্ত। যার ফলে পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। এক ফোঁটা সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করছেন। অনেকে আবার পুকুরের কাদামিশ্রিত ও লবণযুক্ত পানি পান করতেও বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্ব পানি দিবসে পর্যাপ্ত সুপেয় পানি নিশ্চিতের দাবিতে দক্ষিণ -পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের জেলে পাড়ায় শরুব ইউথ টিম ও আশাশুনি উপজেলায় জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের উদ্যোগে মানববন্ধন করেছেন উপকূলবাসী।
নারীরা কলসি কাঁকে নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে আসছেন পানি নিতে। ছবি : টিডিএম
গত রবিবার সরেজমিনে দক্ষিণ -পশ্চিম উপকূল ঘুরে দেখা গেছে খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য পড়ন্ত বিকেলে দূরদূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে পানি সংগ্রহ করছেন উপকূলবাসী।উপকূলের অনেক নারী,পুরুষ ও শিশুরা কাঁকে কলসি নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে আসছেন পানি নিতে। কেউবা ব্যাস্ত কলসিতে পানি ভরতে। আবার অনেকেই কলসিতে পানি ভরে ফিরে যাচ্ছেন আপন ঠিকানায়।
পানি সংগ্রহের এমনি একটি স্হান খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর বটতলা সরকারি পুকুর। এখানে মহেশ্বরীপুর গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পানি নিতে এসেছেন ষাটোর্ধ্ব জোরিনা খাতুন। বয়সের ভারে অনেক পথ হেঁটে আসায় হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। ক্লান্তি দুর করতে কলসি রেখে বিশ্রামে বসে পড়েছেন ঘাটে। বিশ্রামের সময় কথা হয় তার সঙ্গে।
এ সময় তিনি বলেন, পানির অনেক কষ্ট আমাদের। প্রতিদিন চার কলস পানি লাগে আমার। একবারে চার কলস পানি নিতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে দুইবার আসতে হয় এখানে। পানি নিতে আমি আর আমার মেয়ে আসি। দুজন দুকলস করে পানি নিয়ে যাই। তিনি আরও বলেন, বয়স হয়ে গেছে এখন আর আগেরমতো হাঁটতে পারি না। দুইবার পানি আনতে দিনের আধা বেলা লেগে যায়। আমাদের আশপাশে আর কোথাও মিষ্টি পানি না থাকায় এই পানি দিয়ে খাওয়া ও রান্নার কাজ করতে হয়।
গ্রামের নারীরা দলবদ্ধ ভাবে পানি নিতে অপেক্ষা করছে। ছবি : টিডিএম
সাতহালিয়া গ্রামের নাসির মোড়ল বলেন, আমার বয়স ৭৭ বছর। এই জীবন পার করলাম পুকুরের পানি খেয়ে। কারণ আমাদের এখানে টিউবওয়েলের পানি ভালো হয় না। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিসের মাধ্যেমে একবার টিউবওয়েল বসানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু তিন হাজার ফুট গিয়েও মিষ্টি পানি পাইনি। কালিকাপুর গ্রামের চন্দনা সানা বলেন, জলের কষ্ট দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ষাকালে একটু ভালো থাকি তারপর বাকি সময় ধরে খুবই কষ্ট হয় আমাদের। পুকুরের জল খেয়ে প্রায় কোনো না কোনো পেটের রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে আমাদের।
৬নং কয়রা গ্রামের আদিবাসী সদস্য বাসন্তী মুন্ডা বলেন,আমাদের অনেক দুর হতে পুকুরের পানি এনে খেতে হয়। এ রকম সমস্যা অধিকাংশ জায়গায়। আজ ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। পানি সংকট সমাধানের দাবি নিয়ে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি।
শ্যামনাগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় নলকূপের পানি লবণাক্ত হওয়ায় আমরা বড় প্লাস্টিকের ট্যাংকে বৃষ্টির পানি ধরে রাখি। কিন্তু তা দিয়ে বেশিদিন চলে না।বাধ্য হয়ে পুকুরের নোংরা পানি পান করে নানা রকম রোগে ভুগছে এখানকার মানুষ।
ইউপি সদস্য হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু কয়রায় সুপেয় পানির খুবই অভাব। কিছু কিছু এলাকায় টিউবওয়েল সাকসেস হলেও পানিতে আয়রন বেশি। যার ফলে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। কয়রা উপজেলার ৫নং কয়রা, ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রা, পাথরখালী, মঠবাড়ি,তেঁতুলতলার চর, সাতহানি ,চৌকুনী, গাতিরঘেরি সহ অধিকাংশ এলাকায় তিব্র খাবার পানির সংকট রয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর এই পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলায় বসবাসকারী ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করছে। এই পাঁচ উপজেলার মানুষ যে পানি পান করে তাতে গড়ে প্রতি লিটারে এক হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে দুই হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততার উপস্থিতি রয়েছে। যদিও প্রতি লিটার পানিতে এক হাজার মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা পানযোগ্য না।
ওই জরিপে দেখা গেছে, মানুষের পানযোগ্য ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততার উপস্থিতি রয়েছে।
পাঁচ উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়নে বসবাসকারী দুই লাখ ৭১ হাজার ৪৬৪ জন মানুষের মধ্যে ৬৬ হাজার ২৩৪টি পরিবারের ওপর ‘জেন্ডার রেসপনসিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)’ প্রকল্পের আওতায় এই জরিপ পরিচালিত হয়।
গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এই জরিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘উপকূলীয় এই পাঁচ উপজেলায় প্রায় তিন দশক ধরে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া কিছু এলাকায় লবণ পানির চিংড়ি চাষের কারণে সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে। বিভিন্ন সময় দুর্যোগের কারণেও অনেক পুকুর লোনা পানিতে ভরে গেছে। পরে তা আর সংস্কার করা হয়নি।’
গবেষক-বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, খুলনার উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি সংকট নিরসনের একমাত্র ভরসা প্রাকৃতিক পানির উৎস। এ ক্ষেত্রে বৃষ্টি, পুকুর ও পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) প্রযুক্তিকেই উপযুক্ত মনে করেন সবাই। তবে উপকূলবাসীর অভিযোগ, প্রকৃতিনির্ভর দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই প্রকল্প না নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলি বিচ্ছিন্নভাবে যে যার মতো করে কাজ করে যাওয়ায় প্রকৃত সুফল মিলছে না।
কয়রা উপজেলা জনস্বাস্থ্য সহকারী প্রকৌশলী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, কয়রা উপজেলাটি সুন্দরবনের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চলের অর্ধেক মানুষ পুকুরের পানি পান করে থাকেন। লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি কমে যাওয়ায় খাবার পানির সংকট থাকে। তবে সরকারিভাবে ট্যাংক সরবরাহ করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনের সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াছির আরেফীন বলেন, দক্ষিণ -পশ্চিম উপকূলবাসী খাবার পানি সংকট নিরশনে সরকারী পুকুরগুলো সংস্কারের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষনে পলিমার ট্যাংকি বিতরন সহ পানি সংরক্ষণে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
টিডিএম/আরএইচ