ছবি : মেসেঞ্জার
সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার ও দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে চট্টগ্রাম বন্দরের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে শহীদ ফজলুর রহমান মুন্সি অডিটোরিয়াম হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে দেশবাসীকে এ শুভেচ্ছা জানান চবক চেয়ারম্যান।
সংবাদ সম্মেলনে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বর্ণস্থার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম। বন্দরের ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ হতে খ্রীস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম হতে সমুদ্রপাড়ির কথা জানা যায়।
পরবর্তীতে আরব ও ইয়েমেনী বণিকরা এবং তারপর ক্রমান্বয়ে চাইনিজ,পর্তুগীজ,ভার্চ ও ব্রিটিশরাও এই বন্দর ব্যবহার করেছে। তৎকালীন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সরকার ১৮৮৭ সালে পোর্ট কমিশনার্স এ্যাক্ট প্রণয়ন করে যা ২৫ এপ্রিল ১৮৮৮ সালে কার্যকর হয়।
বস্তুতঃ তখন থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তাই প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল "বন্দর দিবস" হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। রীতি অনুযায়ী এ দিবসের প্রাক্কালে গণমাধ্যমের সাথে আমরা মতবিনিময় করে থাকি।
চবক চেয়ারম্যান বলেন, কোভিড অতিমারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতির প্রত্যাশিত গতিকে মন্থর করলেও চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এর তেমন প্রভাব ফেলে নাই, বরং কার্গো হ্যান্ডলিং বেড়েছে এবং রপ্তানী আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
২০২৩ ২০২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই মার্চ) ৪ হাজার ৩৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে যা আগের অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান কাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক। বতর্মানে কন্টেইনার জাহাজ বহিঃনোঙ্গরে আসার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে, ক্ষেত্র বিশেষে অন-এ্যারাইভেল জেটিতে ভিড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২৩- ২০২৪ অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে কন্টেনার হ্যান্ডলিং ২০২২-২০২৩ এর একই সময়ের তুলনায় ৮.২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে ৩.২ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হবে। এছাড়াও ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে জেনারেল কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ৯ কোটি ১৬ লক্ষ ৪৯ হাজার ৬ শ ৫৯ মেট্রিক টন যা গত অর্থবছরে একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
বর্তমান অর্থ বছরের প্রথম ১ মাসে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩০০১টি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের কার্যক্রমের সাথে সহায়ক অন্যান্য সংস্থা এজেন্সী যেমন শুল্ক বিভাগ, ব্যাংক, শিপিং এজেন্টগণ আন্তঃসমন্বয়ের মাধ্যমে সপ্তাহে সাতদিন এবং ২৪ ঘন্টা কার্যক্রম সম্পাদন করছে।
তাছাড়া, চট্টগ্রাম কাষ্টমস এর রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতা ও দক্ষতা।
বিগত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৪৩,০০০ বর্গমিটার কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। উক্ত কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের ফলে অতিরিক্ত ৭,০০০ টিইইউএস কন্টেইনার ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি আরও তিনটি নতুন কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আগত রাসায়নিক পদার্থ সমূহকে নিরাপদে সংরক্ষণ ও ছাড়করণের লক্ষ্যে দ্বিতল বিশিষ্ট ৪২৭৫ বর্গমিটার আয়তনের একটি ক্যামিকেল শেড নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে নদীর উভয় পাড়ে ২৮৫০ মিটার Revetment ও Bank Protection কাজ সম্পাদন করা হয়েছে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে কোন ইক্যুইপমেন্ট স্বল্পতা নাই। গত এক বছরে চবক এর ইক্যুইপমেন্ট বহরে ৫ টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রিক্রেন, ০৬ টি ৪ হাই স্ট্যাডেল ক্যারিয়ার,০৬ টি ২ হাই স্ট্যাডেল ক্যারিয়ার,০৪ টি লোডেড রীচ স্ট্যাকার, ০২ টি ৩০ টন মোবাইল ক্রেন,০৪ টি ২০ টন ফর্কলিফট ট্রাক ও ০৪ টি ভেরিয়েবল রীচ ট্রাকসহ সর্বমোট ৩২ টি ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে।
উক্ত ইক্যুইপমেন্টসমূহ সংগ্রহের ফলে বন্দরের সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট হতে বাকলিয়া চর পর্যন্ত নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর আওতায় ৪৭ লক্ষ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ সম্পাদিত হয়েছে।
কর্ণফুলী নদী ও বন্দর সীমানায় হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে কাজে নির্ভুল পজিশনিং এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ডিজিপিএস বেইজ ষ্টেশন সংগ্রহ করা হয়েছে। ফলে সার্ভে কাজে Precise Positioning নেয়া সম্ভব হচ্ছে। নিজস্ব ড্রেজার খনককে সচল করে চবক এর ড্রেজিং টামকে কার্যকর করা হয়েছে। কর্ণফুলী নেভিগেশনাল চ্যানেল ও জেটির সম্মুখভাগে নিয়মিত সংরক্ষণ ড্রেজিং কাজ সম্পাদন করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে চবক চেয়ারম্যান আরও বলেন,মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের নবনির্মিত চ্যানেলটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃক গ্রহণ করার পর গত ১১ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধন করা হয়েছে। ১৬ মিটার গভীরতা সম্পন্ন চ্যানেলে বয়া এবং নেভিগেশনাল ট্রানজিট স্থাপন করতঃ অদ্যাবধি ১৩৫টি জাহাজ নিরাপদে বার্থিং-আনবার্থিং করা হয়েছে।
ভোজ্যতেলের নির্ধারিত টার্মিনাল হিসেবে পরিচিত RM-8 জেটিতে পূর্বে ১৭০মি. দীর্ঘ ৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং করা হতো। উক্ত স্থানে ডলফিন জেটি নির্মাণের ফলে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাংকার তথা ১৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার ড্রাফটের ট্যাংকার আলোচ্য জেটিতে বার্থিং সুবিধা পাচ্ছে।
পূর্বে উক্ত স্থানে রিভার মুরিং বার্থে অনধিক ১২০০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন তৈলবাহী জাহাজ বার্থিং সুবিধা পেতো। বর্তমানে DOJ-8 এ প্রায় ৫০০০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন তৈলবাহী জাহাজ-এর বার্থিং সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কালুরঘাট সেতু হতে কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত ১৫০০ মিটার ও ৩০০ মিটার আয়তনের দুটি বাঁকে ৭ মিটার গভীরতাসম্পন্ন অভ্যন্তরীণ নোংগরের স্থান সৃষ্টি করা হয় যেখানে প্রায় ৩০০ জাহাজ নোঙ্গরে অবস্থান করতে পারে। ইতোমধ্যে পূর্বের ২২টি সহ নতুন করে ১৫টি মুরিং বয়া স্থাপন করা হয়েছে। এই ৩৭ টি মুরিং বয়ায় অভ্যন্তরীণ জাহাজ এবং ফিশিং ট্রলারসমূহকে সুশৃংখলভাবে মুরিং বয়াতে বার্থিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপিত ভিটিএমআইএস সিস্টেম প্রবর্তনের পর এআইএস এবং রাডারের মাধ্যমে চ্যানেল, বহির্নোংগর এবং উপকূলীয় সাগরে চলাচলকারী জাহাজসমূহের ইলেকট্রনিক সার্ভিল্যান্স নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়,চট্টগ্রাম বন্দরের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আয় হয় জাহাজ সেবা এবং মালামাল হ্যান্ডলিং খাত হতে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ট্যারিফ অনুযায়ী যাবতীয় সেবা প্রদানের বিপরীতে মাশুলাদী আদায় করে থাকে। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের জুলাই-মার্চ সময়কালের তুলনায় ২০২৩-২০১৪ অর্থ বছরের একই সময়ে রাজস্ব আয় ৭.০৯% বৃদ্ধি, রাজস্ব ব্যয় প্রায় ৪.৬১% হ্রাস পেয়েছে এবং রাজস্ব উদ্বৃত্ত প্রায় ১৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
রূপকল্প ২০৪১ কে সামনে রেখে ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ফাস্ট ট্র্যাক ভুক্ত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে জুন-জুলাই ২০২৪ এ নির্মাণ শুরু করা হবে মর্মে আশা করা যায়।
তাছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রাধিকার প্রকল্প বে-টার্মিনালের মাল্টিপারপাস টার্মিনালের নির্মাণ কাজ ২০২৪ এর শেষ নাগাদ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যৌথ উদ্যোগে উক্ত টার্মিনাল নির্মাণের জন্য আবুধাবি পোর্ট গ্রুপ (এডি পোর্টস) ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব দাখিল করেছে।
বে-টার্মিনালের কন্টেইনার টার্মিনাল ১ ও ২ নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য যথাক্রমে পিএসএ সিংগাপুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ড এর সাথে চলতি বছরে চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে আমরা আশা করছি।
দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বে-টার্মিনালের ৪র্থ টার্মিনাল হিসেবে গ্যাস ও অয়েল টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তার বক্তব্যে আরও বলেন,ইতোমধ্যে উক্ত টার্মিনাল নির্মাণের জন্য একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আগ্রহ ব্যক্ত করে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। আশা করা যায় চলতি বছরের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
তাছাড়া, লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ডেনমার্কস্থ বিশ্ব বিখ্যাত টার্মিনাল অপারেটর এপিএম টার্মিনালস প্রস্তাব দিয়েছে যা পিপিপি প্রকল্প হিসেবে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটির ট্রানজেকশন এডভাইজার নিয়োগ। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ টার্মিনাল নির্মাণের কাজও আগামী বছর শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে।
আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চবক চেয়ারম্যান, বন্দর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ, সিবিএ নেতৃবৃন্দ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা কর্মচারীগন উপস্থিত ছিলেন।
মেসেঞ্জার/আকাশ/আপেল