![বাজেটের আগুনে পুড়বে গরিব বাজেটের আগুনে পুড়বে গরিব](https://www.dailymessenger.net/media/imgAll/2024February/1-2406050306.jpg)
ছবি : মেসেঞ্জার
ঢাকা শহরে ২০ বছর রিক্সা চালাচ্ছি এখনো নিজের আয়ের টাকা দিয়ে একটা রিক্সা কিনতে পারলাম না। সারাদিনের আয়ের ৭০ শতাংশ চলে যায় সংসারের দৈনন্দিন খরচে। আর ৩০ শতাংশ বাসা ভাড়ায়। অর্থের অভাবে অসুখ হলে ডাক্তার দেখাতে পারি না। বাজেটে কী আমাদের জন্য কিছু থাকে। সবতো চলে যায় ধনীদের পকেটে। প্রতি বছরই দেখি বড় বাজেট হয় ধনীদের আরও সুযোগ দেয়া হয়। আর দিনশেষে তার বোঝা টানতে হয় আমাদের মতো গরীবদের। এভাবেই গতকাল মতিঝিলে কথাগুলো বলছিলেন রিক্সা চালক আলিম উদ্দিন।
ক্ষোভ রয়েছে শিক্ষার্থীদেরও। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি মেসে থাকেন আকবর হোসেন। তিনি বলেন, গত বছর আমার মেস ভাড়া ছিলো ২৫শ টাকা এখন তাকে গুনতে হচ্ছে ৩২শ টাকা। এক বছরে সাতশ টাকা ভাড়া বেড়েছে। এক বছর পূর্বে মেসের মিল খরচ ছিলো ৩০ টাকার মধ্যে । বছর শেষে ৪৫-৬০ টাকা মিল খরচ পড়ছে। প্রায় দ্বিগুণ খরচ বেড়েছে। এই শিক্ষার্থী বলেন, তার বাবা একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করেন। গত ৩/৪ বছর তার বাবার কোনো স্যালারি বাড়েনি কিন্তু সংসারে খরচ এবং সন্তানদের পড়ালেখার খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার বাবাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণ মানুষদের আয় বৃদ্ধির তুলনায় সব কিছুতে খরচ বেড়েছে। বাসা ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা সবকিছুই ২ ডিজিটের ওপর বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছরই বাজেট আসলে তার আগুনে জলছে যায় গরীব মানুষ। বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, লবণ, চিনি, মাছ, মাংসসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্য। কমেনি চিকিৎসা, যাতায়াত, শিক্ষাসহ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ও। গত ৫২ বছর ধরে দেশের বাজেটের আয়তন ও আকৃতি বেড়েছে প্রতি বছর। কিন্তু প্রকৃতি একই রকম। প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় বাজেট বড় হয়, ট্যাক্সের বোঝা বাড়ে, ধনীদের সম্পদ বাড়ে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাড়ে, আমলা প্রশাসন খাতে বরাদ্দ বাড়ে আর সবশেষে এসবের প্রভাব এসে পড়ে নিম্নভিত্তদের উপর।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে হারে সম্পদ বাড়ছে ওই তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ঋণখেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায় না করে তাদের আরও বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কৃষকরা বিদ্যুৎ না পেলেও নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে ধনীদের। এ কারণে সুবিধাভোগীদের হাতে অবৈধ পুঁজি পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আইএমএফ-এর ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আড়াই দশকে দক্ষিণ এশিয়ার যে তিনটি দেশে আয় বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। দেশ তিনটি হলো বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা।
একটি বেসরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফজলুল হক। তিনি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, ধনীরা বিশাল অঙ্কের ঋণ নিতে পারেন। অথচ ঋণ পরিশোধের হার তাদের মধ্যেই কম। ব্যাংকগুলো তাদের ওপর বেশি চাপ দিতে পারে না। ঋণ পরিশোধের আগেই তাদের আরও বড় ঋণ দেয়া হয়। অথচ ছোট ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে অনেক ধরনা দিতে হয়। অসঙ্গতি রয়েছে দেশের কর ব্যবস্থায়ও। যাদের বেশি করে ট্যাক্স দেয়ার কথা তারা কম ট্যাক্স দেয়। আর যারা কম ট্যাক্স দেয়ার কথা তারাই দেয় বেশি ট্যাক্স। যেমন ধরেন মোবাইল বিল সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গেলে গরিব মানুষকেও ট্যাক্স দিয়ে পন্য কিনতে হয় সেবা নিতে হয়। বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতির গবেষণা বলছে, ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের ৮৭ শতাংশই কোনো ধরনের আয়কর দেন না। এই কারণে এনবিআর কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ ডেইলি ম্যাসেঞ্জারকে বলেন, জনজীবনে মূল্যস্ফীতির চাপতো বেড়ে যাচ্ছে। সেগুলোর কারণে বিশেষ করে গরীবদের উপর একটা প্রভাব পড়ে। তা ছাড়া প্রয়োজণীয় জিনিসপত্রে যদি কর বেড়ে যায় তাহলে সেগুলোতে গরীব মধ্যেভিত্তদেরই বেশি মুখোমুখী হতে হয়। কারণ তাদের আয়ের সাথেতো ব্যায়ের মিল থাকে না। এখনিতো মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদন, যাতায়াতে যদি এবার সরকার আরও কর বাড়িয়ে দেন তাহলে গরীবদের জন্য বড় ক্ষতিগ্রস্থের সম্ভাবনা আছে। বাজেট পেশ পর্যন্ত আমাদের আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। দেশতো মহা অর্থনীতির সঙ্কটের মধ্যে ঢুবে আছে, সরকার আরো ঋন নেওয়ার চেষ্টা করছে। ঋণ যদি না পায় অনেক কিছুরই মুখোমুখী হতে হবে। তখন মূল্যস্ফীতির কারণে শুধু গরিব নয় সবাইকে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে।
নানা চাপের মধ্যেও এবার ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হচ্ছে। এর মধ্যে কর আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি, ফলে রাজস্ব আহরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে আগামী বাজেটে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট হবে অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। যার আকার ধারণা করা হচ্ছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি এই বাজেট টাকার অঙ্কে বাড়বে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি। ঘাটতিও বাড়বে, ঘাটতি হবে অনুদানসহ ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হবে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি পূরণে ঋণ করবে সরকার। প্রাথমিকভাবে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি নেয়া হবে ব্যাংক থেকে আর সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপরে (১১৭০ কোটি মার্কিন ডলার) বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হবে। ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ দিতে হবে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বাজেট উপস্থাপনের আগেই নাগরিক জনজীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ দৃশ্যমান হয়ে গেছে। গতকাল সকালে রাজধানীর মালিবাগে বাজার করতে আসেন হালিমা খাতুন। তিনি বলেন, এক বছর আগেও এক হাজার টাকার বাজার করলে ৩/৪ দিন চলা যেতো। এখন দুইশ থেকে আড়াইশ টাকার নীচে পাঙ্গাস তেলাপিয়া মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। সন্তানরা যে মাছ পছন্দ করেন তা সাড়ে তিনশ থেকে পাচশ টাকার উপরে। যে আলু গত বছর কিনেছি ২০ টাকা দিয়ে বছর শেষে তা ৫৫-৬০ টাকা কিনতে হচ্ছে। তিনি এবং তার স্বামী দুজনেই চাকুরীজীবী দুজনের টাকা দিয়েও সংসার চলছে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বড় অঙ্কের বাজেট ঘোষণা হলেও সাধারণ জনজীবনের উপর ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির চাপ এসে পড়ছে।
মেসেঞ্জার/দিশা