
ছবি : ডেইলি মেসেঞ্জার
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে দেশে এখন সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা দেশটিতে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামাল রয়েছে হাতের নাগালে। শ্রমের মূল্য অনেক সস্তা। বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিতে উৎপাদিত ফসল নষ্টের পরিমাণ কমিয়ে আনা, নিজস্ব কাঁচামাল ও সস্তা শ্রমের সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে পোশাক খাতের মতই কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের খাতটি হতে পারে দেশের অর্থনীতির আরেকটি বড় শক্তিশালী খাত ।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য পণ্যের ব্যাপক চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেখানে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের কৃষি পণ্যের বাজার। জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, বিশ্বজুড়ে ৮২০ কোটি মানুষের বসবাস। সেখানে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে, যা প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখবে দেশের অর্থনীতিতেও।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মতে পোশাক খাত থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ রপ্তানি আয় হয়েছে। সেখানে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ এখনো ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে। অর্থাৎ সরকার ও বেসরকারী উদ্যোক্তারা যৌথভাবে উদ্যোগ নিলে দ্রুত এই শিল্পের বিকাশ হবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানি খাতের মধ্যে এই খাতটি রয়েছে।
কৃষিখাতের সম্ভাবনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন কৃষি মন্ত্রণালয় সচিব ড.মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। তিনি দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, বিশ্ববাজার দুই ধরনের একটি হচ্ছে প্রবাসীদের বাজার (বাংলাদেশী যারা বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত তাদের বাজার), অন্যটি হলো-বিদেশি বাজার। এই দুই বাজারের ভোক্তাদের চাহিদা জানতে মন্ত্রনালয়ের কান্ট্রিওয়াইজ গবেষনা চলছে। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে একটা পলিসি হবে যেটার উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিদেশিরা বাংলাদেশ থেকে আম, কাঁঠাল এবং আনারস আমদানি করতে চায় সুসংবাদ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা নেদারল্যান্ড, জাপান, চীনসহ বেশি কিছু দেশের উদ্যোক্তা এবং রাষ্টদূতদেরকে আমাদের পণ্যগুলো দেখিয়েছি, তারা সেগুলো দেখে পছন্দ করেছেন। আশা করি, এসব পণ্য দ্রুত প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতে পারবো। একই সঙ্গে যাতে চাল, ডাল, পেয়াঁজ, রসুন এবং আদাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমাদানি করতে না হয়, সেই পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। তাতে দেশের কৃষকরা তাদের পণ্যের দাম যেমন বেশি পাবে এবং তেমনি পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এখনো বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। কারণ, সুগন্ধি চাল,মসলা, ড্রিংকস কিংবা স্ন্যাকস পণ্য কেবল প্রবাসীদের কাছে বিক্রি করা হয়।
কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা, অট্রোলিয়া এমনকি এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোর মানুষের কাছে বিক্রি হচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ হলো বিদেশিরা হাইজেনিক এবং নিরাপদ খাদ্য ছাড়া গ্রহণ করে না। তারা জানতে চায় এসব পণ্য উৎপাদনের সময় জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা হয়েছে কিনা? কিংবা কোন ধরনের সার ব্যবহার করা হয়েছে। সব কিছু ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ খাবার হলেই তারা এসব পণ্য কেনেন। অর্থাৎ পন্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছার সব তথ্য যাছাই-বাছাই করে তারা পণ্য গ্রহণ করে।
তিনি ফল, সবজি এমন কী চাল, ডাল উৎপাদনের জন্য তাদের যেসব শর্ত রয়েছে তা পূরণ করে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন। ফলে দেশের কৃষি খাত যেমন সম্প্রসারণ হবে, তেমনি নতুন করে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান বাড়বে বলে আশাবাদ গোলাম মোয়াজ্জেমের।
রপ্তানি বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভেরিফাইড মার্কেট রিসার্চ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বাজার ছিল ১৪৩.৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বার্ষিক ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ২০২৮ সাল নাগাদ এর বাজার হবে ২৩৫. ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে রয়েছে বেভারেজ, ডেইরি, মিট এন্ড পোল্ট্রি, বেকারি, স্ন্যাকস, কনফেকশনারি পণ্য।
এসব পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এ বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ দখলে রেখেছে ইউরোপের দেশগুলো। বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ছোট নেদারল্যান্ডের কৃষিপণ্যের রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশকে এতদূর যেতে হলে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বেশ অগ্রগামী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ড কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে অনেক এগিয়ে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশটির তৃতীয় বৃহৎ শিল্প খাত। দেশটির মোট জিডিপির শতকরা ২৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। প্রতি বছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করে থাইল্যান্ড ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। সেখানে বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের মাত্র ১ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত হয়। অথচ ভিয়েতনামের ৫ শতাংশ, চীনের ৩৮, ফিলিপাইনের ৩১, আমেরিকায় ৭০, থাইল্যান্ডে ৮১ ও মালয়েশিয়ায় ৮৪ শতাংশ কৃষি প্রক্রিয়াজাতের সঙ্গে জড়িত।
উৎপাদিত পন্যের অপচয় রোধ:
কৃষি মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৪০ ভাগ মানুষ কৃষি খাতে কাজ করছে। কিন্তু দেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১২ শতাংশ আর কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাতের অবদান ১.৭ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা অনুযায়ী, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের হিসাবে নষ্ট হওয়া পণ্যের মোট ক্ষতির অংক ৫ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে গত ৫০ বছরের হিসাব যোগ করা হলে এই ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা। যা চলতি জিডিপির সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এখনই সরকার ও উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে পণ্য উৎপাদনের সকল পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে অপচয় রোধ করার পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, আমাদের কৃষি পণ্য উৎপাদন অনেক হয়। কিন্তু তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই সর্বোচ ৫ শতাংশ নষ্ট হয়। এটা যদি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ আনা যায় পাশাপাশি রপ্তানির জন্য পণ্যগুলোর গ্লোবাল গ্যাপ সার্টিফিকেট সরকার থেকে দেওয়া হয়। তবে দেশের চাহিদা পূরণ করে অনেক পন্য রপ্তানিও সম্ভব। একই সঙ্গে রপ্তানির পন্যগুলোকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনার আহবান জানান তিনি।
প্রয়োজন ভর্তুকি বাড়ানো:
বৈশ্বিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড বলছে, বাংলাদেশে কৃষি খাতে জনপ্রতি ভর্তুকি হাজার টাকার নিচে। কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে কয়েক দশক ধরেই কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। তিন বছর ধরেই ধারবাহিকভাবে কমানো হচ্ছে সেই ভর্তুকি। কৃষকদের যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সেটি জনপ্রতি হিসেবে খুবই নগণ্য। বাছাইকৃত দেশগুলোর মধ্যে তলানিতে বাংলাদেশ। দেশীয় বাজার ও রপ্তানি বাড়াতে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
রপ্তানি বাড়াতে যা করণীয়:
রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন(বাপা) মনে করেন, কৃষিখাতের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভালো মানের পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি আরো ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য তৈরি করা। গুড এগ্রিকালচার প্রাকটিসেস অনুসরণ করা। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন, বিশেষ করে বাণিজ্যিক জাত উদ্ভাবন করা। কৃষি খাতকে আধুনিকায়ন করা। কৃষি আধুনিকায়ন করতে হলে অবশ্যই কৃষিতে বিনিয়োগ করতে হবে। পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধার নিশ্চিত করা। উদ্ভাবন এবং গবেষণা ও উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া। পণ্য বহুমুখীকরণে উৎসাহ প্রদান করা। উৎপাদনশীলতা সংক্রান্ত জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ বিষয় নিয়ে যথেষ্ট কাজ করার সুযোগ রয়েছে। জ্ঞানের বিকাশ ঘটতে বর্তমানের চেয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
সংগঠনটি বলছেন, বর্তমানে আমরা যেভাবে পণ্য রপ্তানি করছি সেখান থেকে আগামী দিনে আরও ভালো করতে হলে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণের ফলে আমাদের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাছাড়া মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা গেলে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যাবে।
সরকারের কাছে নীতি সহায়তার প্রস্তাব:
রপ্তানি বাড়াতে তৈরি পোশাক খাতের মতই সরকারকে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির জন্য বিশেষ নগদ প্রণোদনা দেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। এটার পাশাপাশি তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য লাইসেন্স পেতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও চুক্তির নবায়ন সহজ করা, খাদ্যপণ্যের কারখানা বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা ও ব্যাংক ঋণ সহজ করা দরকার বলে মনে করেন। একই সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে দেশের দূতাবাসগুলোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি রপ্তানি হতে পারে এমন সম্ভাব্য দেশগুলোতে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ে গুরুত্ব দেওয়ার প্রস্তাব জানিয়েছে।
এছাড়াও আন্তর্জাতিকমানের ল্যাব বাড়ানো, অর্গানিক ও মানসম্মত কাঁচামাল উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কম জমিতে অধিক ফলন পেতে কৃষকদের নীতি সহায়তা গ্রহন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
এ সার্বিক বিষয়ে রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাপার ইকতাদুল হক দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, পোশাক খাতের মতই রপ্তানিমুখী কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দিতে হবে। পণ্য রপ্তানিতে বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বন্দরে সহজে পণ্য আনা-নেওয়া এবং খালাসে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরী।
আর্থিক সহায়তার কথা প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষকদের নামে মাত্র সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যাতে ঋণ পায় সেটি তদারকি করতে হবে। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কারখানা প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম পরিচালনায় স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারখানার প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক শূন্যতে নামিয়ে আনতে হবে। পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবহন ক্রয়ে শুল্ক না রাখার পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ভাড়ায় বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি খরচে সরকারের বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য না হওয়া। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে বিনিয়োগে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা না থাকা। কৃষিপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক মুক্ত সুবিধা না থাকা। কৃষি উপকরণ যন্ত্রের দাম বেশি হওয়া। জাহাজ ভাড়ায় ভর্তুকি না থাকা। কৃষকদের জন্য বেশি সুদে ঋণ- এসব বাঁধা দূর করা দূর করতে হবে।
কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য পরিবহনে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। তাহলে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পন্য সেক্টর দ্রুত বিকাশ হবে বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান:
বাপার তথ্য মতে, বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের অভ্যন্তরীন বাজার ৬০ হাজার কোটি টাকা পূরণ করে বাপার সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোরপাশাপাশি বিশ্ববাজারে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। তার প্রমাণও মিলেছে ইপিবির পরিসংখ্যানে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাত থেকে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় এসেছে। সে বছর এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১০২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। তার আগের বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় করেছিল ৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
তারপরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১১৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি ২৭ শতাংশ কমে ৮৩ কোটি ডলারে নেমেছে। ২০২২-২৩ সালে রপ্তানি আয় ছিল ৮২৯.২১ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকেও রপ্তানির তথ্য একই দেখিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি ও কৃষিজাত পন্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৮৬২ মিলিয়ন ডলার,২০২০-২১ অর্থবছরে ১০২৮ মিলিয়ন,২০২১-২২অর্থবছরে ১১৬২ মিলয়ন,২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৩৩ মিলিয়ন এবং ২০২৩-২৪ সালে ৯৫৬ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে।
২০২৪ সালে রপ্তানি কম হলেও সর্বোচ্চ আয় হয়েছে শুকনা খাবার রপ্তানি থেকে। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করেছে ২১৭ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ২০০.৭ মিলিয়ন ডলার।
সবজি রপ্তানি বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এ খাতে আয় হয়েছে ১১৩ মিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরে ছিল ৬১ মিলিয়ন ডলার। তামাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৮২ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। গত বছর আয় হয়েছিল ১৬৫ মিলিয়ন ডলার।
ফুল ও ফল রপ্তানি বেড়েছে অনেক গুণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ মিলিয়নের রপ্তানির বিপরীতে গত অর্থবছর আয় হয়েছে ২৯ মিলিয়ন ডলার। মসলা রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৫৭ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর ছিল ৪২ মিলিয়ন ডলার। অন্য পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে ৩৬৭ মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৩৬২.৯ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, ১৪৫ দেশে প্রায় ৬৩ ধরনের মৌলিক কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যসহ প্রায় ৭০০ ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ১০০০ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রপ্তানির সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৫০ প্রতিষ্ঠান। বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ২০টি। এ খাতে কর্মসংস্থান প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের। কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে প্রায় ৮ শতাংশ অবদান রাখছে। এটা কয়েকগুণ বৃদ্ধি সম্ভব।
২০২৩-২০৪ সালে যে রপ্তানি আয় হয়েছে। তার মধ্যে এশিয়া মহাদেশের ৩৫টি দেশে থেকে এসেছে ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ চার ভাগের তিন ভাগ। বাকি একভাগ পণ্য রপ্তানি হয়। ইউরোপ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং অষ্ট্রোলিয়া মহাদেশে। তার মধ্যে যথাক্রমে ইউরোপের২৩টি দেশে ১১ শতাংশ, আমেরিকা ৮টি দেশে ৭ শতাংশ, আফ্রিকার ২৯টি দেশে ৫ শতাংশ এবং অষ্ট্রোলিয়া মহাদেশের ৮টি দেশে ৩ শতাংশ।
দেশ ভিক্তি রপ্তানি শীর্ষে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটিতে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৭৩ মিলিয়ন ডলার পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছে সৌদি আরবে। দেশটি থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৫৭ মিলিয়ন। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। পাশ্ববর্তী দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৮ মিলিয়ন ডলার পণ্য। তারপর ২৫ মিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্য থেকে। মালেশিয়াতে রপ্তানি হয়েছে ২০ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে ১৯ মিলিয়ন, ফিলিপাইনে হয়েছে ১৩ মিলিয়ন, কাতারে হয়েছে ১১ মিলিয়ন, ওমানে ১১ মিলিয়ন এবং কানাডাতে ৭ মিলিয়ান ডলার পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
রপ্তানিতে শীর্ষে থাকা দেশিয় প্রতিষ্ঠান:
আশার কথা হচ্ছে-বিদেশ থেকে যে পণ্যগুলো রপ্তানি হচ্ছে। তার ৬০ শতাংশ আয় এসেছে প্রাণ আরএফএলের পণ্য থেকে। অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের ৬০ কোটি ডলারসম পরিমাণ টাকা রপ্তানি আয় এসেছে প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের পণ্য থেকে। রপ্তানিতে দেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রাণের পরেই অবস্থান রয়েছে হবিগঞ্জ এগ্রো লিমিটেড। তৃতীয় স্থানে রয়েছে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড। তারপর যথাক্রমে রয়েছে কৃষাণ স্ন্যাকস,বাংলা মিলারস, ময়মনসিংহ এগ্রো লিমিটেড ইউনিট-২ এবং হিসমা ফুডস লিমিটেড।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, বড় কারখানার পাশাপাশি ক্ষুদ্র কারখানাগুলোতে দেশভিত্তিক গবেষনা করে ইনোভেশনের মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি করা শুরু করলে-একদিকে বাংলাদেশ বৈদেশি মুদ্রা আসবে। অপরদিকে কৃষকের মুখে হাঁসি ফুটবে। পাশাপাশি নতুন করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা ওভার-কাম করতে হবে।
দূর করতে হবে যত বাধা:
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের বাহিরে ১ কোটি ২৫ লাখ ২৪ হাজার ২৯৮জন প্রবাসী রয়েছেন। ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২৬ হাজার ৯০৮ কোটি মার্কিন ডলার। এই প্রবাসী ও বাকি ৮০০ কোটি মানুষের বাজারে রপ্তানি বাড়াতে ৫টি বাধা রয়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতে বলছে বাপা।
এর মধ্যে প্রথমটি হলো-সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। বাপা বলছে, সরকার গত বছরের জুন মাসে হঠাৎ করে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, এ কারণে কৃষি- প্রক্রিয়াজাতকরণ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি কমে গেছে। কারণ আমদানীকারক সুগন্ধি চালের সঙ্গে কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ অন্যান্য পণ্যের ক্রয় আদেশ প্রদান করতো, চাল বন্ধের ফলে কৃষি- প্রক্রিয়াজাতকরণ অন্যান্য পণ্যের ক্রয় আদেশও বাতিল করছে। এর ফলে এই খাতের রপ্তানি কমে যাচ্ছে এবং রপ্তানীকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ পাশ্ববর্তী দেশে সুগন্ধি চালের রপ্তানি চালু রয়েছে। এই সুযোগে তারা বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিচ্ছে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- চুক্তিভিত্তিক উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা-প্রণোদনা প্রদান। চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তার সুবিধা না থাকায় রপ্তানি বাজারে প্রতিবন্ধকতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমাদানিকারীদের চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানিকারকরা চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের মাধ্যমে উৎপাদিত অনেক পণ্য রপ্তানির করে থাকে। কারণ সবগুলো পণ্য একটি কোম্পানীর পক্ষে উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তাই চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তার সুবিধা প্রদান করা হলে এই খাতের রপ্তানি বাড়বে।
তৃতীয় কারণ হল-নগদ সহায়তা-প্রণোদনার হার পূর্বের মত বহাল অথবা সোর্স টেক্স রহিতকরণ। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারিকৃত এফ.ই সার্কুলার নং ২ অনুযায়ী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাতের রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তার হার ২০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করায় রপ্তানি কমে যাচ্ছে। নগদ সহায়তার উপরে সোর্স টেক্স ১০ শতাংশ কর্তন করা হয়, যা রহিত করা প্রয়োজন অথবা এআইটি হিসেবে গণ্য করা। প্রতি রপ্তানির বিলের উপর ১ শতাংশ টেক্স কর্তন করা হয়, রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে তা কমানো প্রয়োজন।
চতুর্থ কারণ হলো-কৃষি-প্রত্রিয়াজাতকরণ পণ্যের কাচামালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য উৎপাদনে কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া রপ্তানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাজারে টিকে থাকা কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের পাশের দেশগুলোতে কাঁচামালের মূল্য আমাদের তুলনায় অনেক কম তাই আমাদের রপ্তানির বাজার সংকোচিত হচ্ছে। যেমন: চিনি।
পঞ্চম কারণ হল-হালাল পণ্যে রপ্তানি লক্ষ্যে সনদ প্রদানের কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ। বিশ্ব-অর্থনীতির সঙ্গে তালমিলিয়ে রপ্তানির বাজারে পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং রপ্তানি বাজার বহুমুখীর ফলে বিশ্বে হালাল পণ্যের বাজারের আকার দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রকৃতিকভাবেই বাংলাদেশে অনেক হালাল পণ্যে উৎপাদন হয় কিন্তু বাজারের পণ্য রপ্তানি করতে গেলে যেসব নিয়ম-নীতি পরিপালন করা দরকার, তা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তাই, হালাল বাজারের পণ্যের রপ্তানি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ম-নীতি গুলোর ব্যাপারে সচেতনতা করা খুবই জরুরী।
রপ্তানি বাড়াতে বড় কোম্পানির পরিকল্পনা:
১ বিলিয়ন পন্য রপ্তানির মধ্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো একাই ৬০ শতাংশ রপ্তানি করছে। নতুন নতুন কৃষি ও কৃষি জাত পন্যের উদ্ভাবনের ফলে দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান বাড়ছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার উন্নতি পাশাপাশি মানসম্মত খাদ্য, গৃহস্থালী ও বিভিন্ন ধরনের কৃষিভিত্তিক পণ্য সাধারণ মানুষের হাতে পৌছেনোর উদ্দেশ্যে ১৯৮১ সালে যাত্রা হয়।বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩০টি কারখানা রয়েছে। গত ৪৩ বছরের ১ লাখ ৪৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। যাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রুপের নির্ভরশীল প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। অর্থনীতিতে অবদানের জন্য সরকারের কাছ থেকে পরপর ২১ বার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন উদ্যোগ নিয়েছে দেশের বাহিরে কারখানা তৈরি করে পণ্য রপ্তানির।
এ বিষয়ে প্রাণ-আএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। সেখানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭০০ কোটিরও বেশি এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা অনেক। ব্যবসার অনুকূলে আমাদের অনেক সুবিধা যেমন সস্তাশ্রম, কাঁচামালের সহজলভ্যতা, অল্প দামে জমি, কাজের জন্য ভালো পরিবেশ রয়েছে। এগুলো কাজে লাগিয়ে যদি মানসম্মত পণ্য সহনীয় মূল্যে বাজারে আনতে পারি তাহলে আমরা বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানির বড় অংশ দখল করতে পারব। তিনি বলেন, এরই মধ্যে প্রাণ থেকে বিভিন্ন দেশের বড় বড় কোম্পানি ও ব্র্যান্ড পণ্য কৃষি পণ্য আমদানি করছে।
রপ্তানিতে শীর্ষ দশে রয়েছে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ব্রান্ড ম্যানেজার এসএম রিশাত তানভীর দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, স্কয়ার এখন ১৩ মিলিয়ন ডলার কৃষি পণ্য রপ্তানি করে, আমাদের টার্গেটে এটাকে ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার। আমরা দ্রুত রপ্তানি দ্বিগুণ করতে চাই। এ জন্য নতুন নতুন পন্য রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ অবদান রাখছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হলে-সরকারকে বন্ধ রেডিয়েশন চালু করতে হবে। পন্য সার্টিফাইয়ের জন্য আরও একাধিক রেডিয়েশন চালু দরকার। এছাড়াও বেশ কিছু দিন ধরে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে, সরকারের উচিৎ এই নির্দেশ প্রত্যাহার করা।
স্ন্যাকস জাতীয় পণ্য মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ রপ্তানি করছে বোম্বে সুইটস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার (ইন্টারনেশনাল বিজনেস অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) খুরশীদ আহমেদ দি ডেইলি ম্যাসেঞ্জারকে বলেন, দেশের পাশাপাশি বিদেশে বাজার বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। এই লক্ষ্যে স্ন্যাকস জাতীয় পণ্যের পর আমরা নতুন করে বাজারে মসলাও (হলুদ, মরিচ ধনিয়া ও জিরা) নিয়ে এসেছি। আমরা পুষ্টিগুণ ঠিক রেখে সুলভ মূল্যে বিক্রি করছি। আরও বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের পণ্য নিয়ে গবেষণা করছি। সরকারের উচিৎ নীতি সহায়তাসহ অনান্য সকল সুযোগ সুবিধা দেওয়া। তাহলেই দ্রুত রপ্তানি আয় বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
রপ্তানির সম্ভবনাময় বাজার:
বাপার গবেষণায় বলা হয়, আফ্রিকা, আসিয়ান ও সার্কভুক্ত দেশগুলোতে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির অত্যন্ত সম্ভাবনাময়,তাই এসব দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। অঞ্চলগুলোতে শুল্ক মুক্ত পণ্য প্রবেশে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য বাঁধা দূর করতে সরকারকে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ভারত, নেপাল ও ভুটান খাদ্যপণ্যের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাজার,এখানে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাঁধা দূর করতে হবে।
তাছাড়া বর্তমানে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে সরকার ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ খাতে নগদ প্রণোদনা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এ খাতের রপ্তানি এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। এ চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে সরকারকে অবশ্যই নগদ প্রণোদনা বিকল্প হিসেবে নানা ধরনের সহায়তা প্রদান করতে হবে। তাহলে এ খাত টিকে থাকবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম উদ্দিন দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, সার্ক ও আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশের সাথে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করা হচ্ছে। এসব দেশে চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে শুল্ক মুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকে। তবে যদি না পারা যায় তবে যেন শুল্ক বা কোটা মুক্ত প্রবেশের ধীরে ধীরে কমানো হয় তার জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে।
যা রপ্তানি হচ্ছে:
দেশের চাহিদা পূরনের পাশাপাশি যেসব পন্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শাক-সবজি। যেমন কাঁচামরিচ,লাউ, কুমড়া, বেগুন, ঢ্যাঁড়শ, পেঁপে, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, বরবটি, শিম, টমেটো। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য যেমন জুস অ্যান্ড ড্রিংকস, স্ন্যাক্স, বিস্কুট, কালিনারি, কনফেকশনারি, ফ্রোজেন ফুডসসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়।
নতুন করে যা রপ্তানির সুযোগ:
কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে আগামীতে এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায় নতুন করে ক্যানিং সবজি, প্রক্রিয়াজাত রেডি সবজি, প্রয়োজনীয় সবজির জুস,স্ন্যাকস, বীজ আকারে সবজি রপ্তানি করা যাবে। ফলের মধ্যে জ্যাম ও জেলি, ফলকে ক্যানিং করে, ফ্রোজেন ফল আকারে কিংবা ফলের পাউডার আকারে রপ্তানি করা। এছাড়াও কাঁঠাল, আনারস, কলা, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফলে মূল্য সংযোজন করে রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভব। শস্যের মধ্যে শুকনা খাবার কিংবা গুড়া মশলা আকারে পাউডার করে, সবজি আকারে, প্রসেস রেডি ফুড আকারে যেমন স্ন্যাকস, নুডলস, পাস্তা, পিঠা, কেক ও বেকারি আইটেম।
মাছের মধ্যে তাজা মাছ ফ্রোজেন আকারে, মাছ ফ্রাই আকারে, রেডি ফুড (রান্না) আকারে ক্যান কিংবা প্যাকিং করে, ড্রাই মাছ আকারে রপ্তানি করা যাবে। দুগ্ধজাত পণ্য (ডেইরি) ঘি, ইউএচটি দুধে মূল্য সংযোজন করে উন্নতমানের চীজ, বাটার, মিল্ক পাউডার রপ্তানি করা যাবে। এছাড়াও ফ্রোজেন আইটেম তৈরি করে চিকেন নাগেট, সিঙ্গারা, সমুচা রপ্তানি করা সম্ভব।
রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়:
২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে হলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবদ্ধকতা রপ্তানি আয়ের পথে বাঁধা হিসেবে কাজ করছে। আগামী দিনে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি বাড়াতে হলে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প হতে পারে বড় হাতিয়ার। এক্ষেত্রে এ শিল্পকে গুরুত্ব দিলে দেশের রপ্তানিখাত সমৃদ্ধ হবে। তবে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হলে এবং আগামী দিনে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌছালে যখন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার কমে যাবে তখন বেশকিছু পদক্ষেপ এখন থেকেই নেয়া জরুরি।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক দি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করলে সব সেক্টরেই প্রণোদনা বন্ধ হয়ে আসবে। তাই বিকল্প হিসেবে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য আমাদের আলোচনা শুরু করতে হবে।
কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতে নারীদের অবদান:
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফও)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে কৃষি খাতে নারীদের অবদান ৪৫.৩ শতাংশ। আর পুরুষদের অবদন ৫৪.৯৭ শতাংশ। ২০০৫ সালের প্রতিবেদন অনুসারে নারীদের অবদান ছিল ৩৬.২ শতাংশ। সেখান থেকে ৯.১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫.৩ শতাংশে। কৃষি প্রক্রিয়াজত কারখানা বৃদ্ধির কারণে এ খাতে নারীদের অবদান বেড়েছে। কারখানাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। কৃষি কাজে ঘরে কাজ সামলিয়ে নারীরা এখন সমান তালে পুরুষদের সাথে কাজ করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সচিব ড.মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, নারী যতই এগিয়ে আসবে, কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে রপ্তানির চাকা আরো সচল হতে থাকবে।
মেসেঞ্জার/সজিব