
ছবি: ইন্টারনেট
বাংলা চলচ্চিত্রের অনবদ্য এক নাম মান্না। যার পারিবারিক নাম এস এম আসলাম তালুকদার মান্না। সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর ঢাকাই সিনেমার হাল একাই ধরেছিলেন এই তারকা। সামাজিক, রোমান্টিক, অ্যাকশন- সব ঘরানার সিনেমা দিয়ে দর্শকের মন জয় করে নেওয়া প্রয়াত এ অভিনেতা এখনো ভক্তদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। আজ পহেলা বৈশাখ এই মহা নায়ক মান্নার জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতির কৈতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
১৯৮৪ সালে এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে চলচ্চিত্রে আসেন মান্না। তাঁর প্রথম অভিনীত ছবির নাম ‘তওবা’। কিন্তু প্রথম মুক্তি পায় ‘পাগলী’ ছবিটি। ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘কাসেম মালার প্রেম’ ছবিতে প্রথম একক নায়ক হিসেবে অভিনয করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর আগে সব ছবিতে মান্না দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন। ‘কাসেম মালার প্রেম’ দশর্কের মাঝে বেশ সাড়া ফেলার কারণে মান্না একের পর এক একক ছবিতে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। কাজী হায়াতের ‘ত্রাস’ সিনেমা ব্যবসা করলে তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রায় দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে বেশ দাপটের সাথেই অভিনয় করে গিয়েছেন তিনি।
জনপ্রিয় নায়ক মান্না বঞ্চিত মানুষের কথা সিনেমার পর্দায় সুনিপুণ অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেন। নব্বই দশকে অশ্লীল চলচ্চিত্রের ধারা শুরু হলে যে কজন প্রথমে এর প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের মধ্যে নায়ক মান্না অন্যতম। যদিও মাত্রাতিরিক্ত অশ্লীল ছবি ’ফায়ার’ ছিল মান্না অভিনীত। তারপরও তিনি রীতিমত যুদ্ধ করেছিলেন অশ্লীল ছবির বিরুদ্ধে। অবশেষে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিলেন চিত্রনায়ক মান্না।
’দাঙ্গা’, ‘লুটতরাজ’, ‘তেজী’, ’আম্মাজান’, ‘আব্বাজান’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার চূঁড়া ছঁয়েছিলেন মান্না। মান্না অভিনীত ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে ব্যবসা সফল ও জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
’কে আমার বাবা’, ‘লাল বাদশা’, ‘আব্বাজন’ এর মতো সুপারহিট ছবিতে অভিনয় করে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন নায়ক মান্না। এ সকল ছবিতে নায়ক মান্না ছিলেন জীবন্ত ছবি। তাঁর প্রতিটি অভিনয় ছিল বাস্তব, জীবন্ত ও প্রাণবন্ত।
শুধু অভিনেতা হিসেবে নয়, প্রযোজক হিসেবে তিনি বেশ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ভক্তদের মণিকোঁঠায় সহজেই ঠাঁই পেয়েছিলেন। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে যতগুলো ছবি প্রযোজনা করেছেন তার প্রতিটি ছবিই ব্যবসা সফল ছিল। ছবিগুলো হচ্ছে- ‘লুটতরাজ’, ‘লাল বাদশা’, ‘আমাজ্জান’, ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’, ’দুই বধু এক স্বামী’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’, ‘মান্না ভাই’ ও ‘পিতামাতার আমানত’। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
একে একে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘অন্ধ প্রেম’, মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘প্রেম দিওয়ানা’, ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দেশদ্রোহী’, ছবিগুলো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মান্নার অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।
এ তারকা তাঁর মৃত্যুর আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন তাঁর ইচ্ছে তিনি সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য একটাই তিনি মানুষের সেবা করতে চান। নায়ক মান্না মনে করেছিলেন সংসদ সদস্য হলে তিনি মানুষের জন্য কাজ করতে পারবেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছিলেন অপি করিম। উপস্থাপিকা মান্নাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মান্না ভাই কখনও কি নির্বাচনে অংশ নেয়া ইচ্ছে আছে আপনার। হাসি মুখে উত্তর দিয়ে মান্না বলেছিলেন ’আমি নির্বাচন করব, আজ অথবা কাল আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব, আমার ভীষণ ইচ্ছে আছে তবে সেটা সেবামূলক ভাবনা থেকেই’।
মান্নার সহধর্মিনীর নাম শেলী মান্না। তাঁদের পুত্র সিয়াম ইলতেমাস দেশের বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মিডিয়া এন্ড ফিল্ম স্টাডিজ’ এ পড়াশোনা করেছেন।
২০০৩ সালে ‘বীর সৈনিক’ চলচ্চিত্রের জন্য মান্না প্রথম বারের মত শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ১৯৯৯ সালে ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রের জন্য বাচসাস পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার জিতে নেন মান্না। মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারে ১৯৯৯, ২০০০ এবং ২০০৭ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার জিতে নিয়ে ছিলেন নায়ক মান্না।
২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে নায়ক মান্না মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর জানাজা এফডিসিতে হয়। দ্বিতীয় জানাজা স্মৃতিসৌধে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দর্শকরা তাঁকে এতটাই ভালবাসে এবং শ্রদ্ধা করে যে ভক্তকূলের ভীড় এবং পুরো ঢাকাই অত্যন্ত জ্যাম থাকায় তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত তাঁর নিজ গ্রাম এলেঙ্গায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মান্না। বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে মান্না নামটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জনপ্রিয় নায়ক মান্না তাঁর ভক্তদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
টিডিএম/এনএম