
ছবি : মেসেঞ্জার
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আর ইয়াসির আরাফাতের নাম শুনে শুনেই বড় হয়েছি আমরা, ফিলস্তিনের উপর ইসরাইলের হামলা, গাজা, পশ্চিম তীর, তেল আবিব , জেরুজালেম এই নামগুলো কোন কারণ ছাড়াই আমাদের প্রজন্মের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে হামলা আর রক্তাক্ত লাশের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সেই লাশের সারি দশকের পর দশক ধরে শুধু বাড়তেই আছে। রক্তাক্ত ফিলিস্তিনের মুক্তি মিলেনি।
গত সপ্তাহে লন্ডনে একটি প্রতিবাদ সমাবেশে শামিল হয়েছিলাম। আবাল বৃদ্ধ বণিতা, পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ সেখানে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবী জানিয়ে সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে ইহুদী ধর্মালম্বীরা ও গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে সমবেত হয়েছিলেন। গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে ছিলেন সেখানে লেখা ছিল ” ইহুদিরা গণহত্যা সমর্থন করেন না”
অন্যদিকে , ১৬৪টি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ২৮টি রাষ্ট্র (মূলত মুসলমান অধ্যুষিত) এখনও ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়নি এবং এর সাথে তাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তবে নিকটতম দুই আরব প্রতিবেশী মিশর ও জর্দানের সাথে ইসরায়েল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং দেশ দুইটির স্বীকৃতিও লাভ করেছে। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রই দুইটি দেশকেই স্বীকৃতি দিয়েছে , স্বাধীন ফিলিস্তিনের অন্তরায় তাহলে কোথায় ?
আমরা বহু বছর ধরে শুধু ফিলিস্তিন অংশের বক্তব্য গুলো শুনছি , ফিলিস্তিনের প্রতি তাই আমাদের আবেগের পাল্লা ও ভারী, তার চেয়ে ও বেশী আবেগ ধর্মীয় কারণে। কারণ মক্কা মদিনার পর তৃতীয় স্থানটি দখল করে আছে জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা। মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা বলা হয় আল আকসা কে। কিন্তু ইসরাইল কোন কারণে, সেখানে তাদের দখলদারীত্ব বজায় রেখেছে, সেই দাবীর যুক্তি কি বা রহস্য কি?
ইহুদিরা তাদের পূর্বপুরুষ আব্রাহাম, আইজ্যাক ও জ্যাকব (ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব আ.) এর বসবাসের পূণ্যভূমি হিসেবে একে পবিত্রভূমি হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেই বিবেচনা থেকে এই ভূখন্ডকে নিজেদের বসবাসের জন্য প্রতিশ্রুত ভূখন্ড হিসেবে দাবি করে। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মের প্রবাদপুরুষ যিশু খ্রিস্টের (ঈসা আ.) এর জন্মভূমি হিসেবে একে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। অপরদিকে মুসলমানরা বিভিন্ন নবীর জন্ম ও কর্মভূমি এবং রাসূল (সা.) এর মিরাজ যাত্রার স্মৃতি স্বরূপ ফিলিস্তিনকে সম্মানিত পবিত্রভূমি হিসেবে মর্যাদা দান করে। সকলের কাছেই পবিত্র বলে বিবেচিত হলেও এই পবিত্রভূমিতে রক্তপাতের পরিমাণ কম নয়।
ইতিহাস ঘাটলে , তাদের সেই দাবীকে অস্বীকার করার ও সুযোগ নেই। কারণ চার হাজার বছরের ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় সেখানে মানব সভ্যতার এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ইহুদী জাতি গোষ্ঠীর অস্থিত্ব ও স্বীকার করে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ছয় হাজার ইহুদি নিহত হয়েছিল। ইহুদিরা মনে করে তারা যদি সে যুদ্ধে পরাজিত হতো তাহলে আরবরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতো।
ইসরায়েলিরা মনে করেন ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ সেভাবে দু'টি দেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেটি যদি ফিলিস্তিনীরা মেনে নিতো তাহলে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল নামের দুটি দেশ এখন পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ অবস্থান করতো।তাই তাদের ভাষ্য মতে ইসরাইলের জন্য ও এই যুদ্ধ আসলে নিজেদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ।
প্রাচীন ইতিহাস হিসাব করলে ফিলিস্তিনের এই যুদ্ধ হাজার বছর গিয়ে ঠেকবে । যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বর্তমান ইসরাইল রাষ্ট্রের সময়কাল থেকে গণনা করি তাহলে এর ইতহাস , ভারত ভাগের সমান্তরাল। যেভাবে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল ভারতবর্ষ। ভারত ও পাকিস্তান । ঠিকই একই সময়ে জন্ম নিয়েছিল ইসরাইল। ভারত , পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বহু যুদ্ধ ও রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের ও আছে। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ধামামা এখন ও মাঝে মাঝে বেজে উঠে। কিন্ত ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলতেই আছে এর কি আদৌ কোন যুক্তিক সমাধান নেই? বছরের পর বছর ধরে এই যুদ্ধ চলতেই থাকবেই ।
১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘে ১৮১ নং প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিন ভূখন্ডে একটি ইহুদি এবং একটি আরব রাষ্ট্র গঠন করার ঘোষণা করা হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী পরবর্তী বছর ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সমাপ্তিতে ফিলিস্তিনের ৫৬ শতাংশ ভূমি নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের গঠিত হয়। এরপূর্বে তারা দখলকৃত ভূমির আরব বাসিন্দাদের তাদের আবাস থেকে বিতাড়িত করে সেখানে বহিরাগত ইহুদিদের পূর্ণবাসন করে। প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিনের আরবরা ৪৪ শতাংশ ভূমির অধিকারী হলেও তারা অখন্ড ফিলিস্তিনের দাবিতে নব্যগঠিত ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু যুদ্ধে ইসরাইল আরবদেরকে পরাজিত করে ফিলিস্তিনের ৮০ শতাংশের অধিক ভূমি দখল করে। ফিলিস্তিন ভূখন্ডের এই বিপর্যয়ে সাত লক্ষ আরব ফিলিস্তিনি নিজের আবাস থেকে উৎখাত হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। এরা ফিলিস্তিন ভূখন্ড ও ফিলিস্তিন ভূখন্ডের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ফিলিস্তিনের জাতীয় ইতিহাসে এই বিপর্যয়কর ঘটনা আল-নাকবা নামে পরিচিত।
এই অখন্ড ফিলিস্তিন ধারণা শক্তিশালী ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোন ভাবেই কার্যকর হবে বলে বর্তমান সময়ে বিশ্বাস করা দুরুহ। ভবিষ্যৎ কি স্বাক্ষ্য দেবে সেটি জানি না।
এই সংকট সমাধানে অসলো চুক্তিই কি মুক্তির পথ ?
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন যে সব ইস্যুতে একমত হতে পারছেন না, এর মধ্যে আছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে; পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদী বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে, নাকি সরিয়ে নেয়া হবে; জেরুজালেম নগরী কি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে; আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে- ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন। গত ২৫ বছর ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। কিন্তু সংঘাতের কোন সমাধান এখনো মেলেনি।
অসলো চুক্তি অনুসারে প্যালেস্টাইন অথোরিটি নামে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়; যারা পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় স্বায়ত্তশাসন কায়েম করতে পারবেন। এই চুক্তির কারণে পিএলও ইসরাইলের স্বীকৃত স্থায়ী মিত্র হিসেবে বিবেচিত হবে; যার ফলে বিবদমান প্রশ্নগুলো গুলো নিয়ে আলোচনা করার দ্বার উন্মুক্ত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো ছিল ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের সীমানা নির্ধারণ, ইসরাইলিদের আবাসন প্রক্রিয়া, জেরুসালেমের মর্যাদা, ইসরাইলি সৈন্যদের উপস্থিতি এবং ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নেওয়ার পর মিলিটারীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কী করা হবে ও ফিলিস্তিনিদের ফিরে আসার অধিকারের ব্যাপারে আলোচনা করা।, অসলো চুক্তিতে ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কিছু বলা হয় নি।
দুইটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের পরিবর্তে একক রাষ্ট্র গঠন করে সমাধানের কথা বিকল্প হিসেবে চুক্তিতে বলা হয়েছিল। এরফলে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের সমস্ত অঞ্চলকে একত্র করে একটি রাজ্য বলা হবে এবং একজন সরকার থাকবে। এর ফলে কোনো পক্ষই সমস্ত ভূমিকে নিজের বলে দাবী করতে পারবে না। যা মূলত দুঃস্বপ্ন বা অলীক কল্পনা। ইসরাইল ফিলিস্তিন একক রাষ্ট্র হওয়ার আর কোন সুযোগ নাই।
তাই ফিলিস্তিন কে অখন্ড ফিলিস্তিন ধারণা থেকে ফিরে আসতে হবে। দুটি পৃথক রাষ্ট্র ধারনায় সমাধান খুঁজতে হবে। ১৯৪৮ সালের পর যে সমস্ত অঞ্চল ইসরাইল দখল করেছে, সেই সব অঞ্চল ফিলিস্তিন কে ফেরত দেয়া , সর্বোপরি জেরুজালেম কে একক অধিকার থেকে দুই দেশকেই সরে আসতে হবে। হয় পূর্বের ঘোষিত জাতিসংঘের অধীনে থাকতে পারে। কারণ এই যুদ্ধ আটকে আছে জেরুজালেমে। আমেরিয়াক বা আরব বিশ্ব নয় সমাধানে ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলকে খুঁজতে হবে। তার আগে হামাস নিয়ন্ত্রত গাজা ও ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর বা মূল ফিলিস্তিন এক শাসন ব্যবস্থায় ফিরতে হবে।
সেদিন কথা প্রসঙ্গে এক সিনিয়র বন্ধু বললেন , দেশ একটি ধারণা মাত্র, পুরো পৃথিবীটাই আসলে মানুষের। যে ভাবে ধর্ম ও একটি ধারণা মাত্র। দেশ এবং ধর্মের মারপ্যাঁচে পৃথিবী আজ বিভক্ত। মানুষকে শাসন করার জন্য নেতাদের একটি প্রক্রিয়ার নাম হচ্ছে রাষ্ট্র। আর বারবার যুদ্ধের নামে রক্তাক্ত হয় পৃথিবী , মৃত্যু হয় সাধারণ মানুষের। এই দেশপ্রেম নিয়ে চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত কথাগুলো সেখানে মিলে যায়। চার্লির আমেরিকার নাগরিকত্ব না নেয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে , বলেছিলেন, নাগরিকত্ব একটা দেশে থাকার আবশ্যক শর্ত নয়। আর চার্লি সরবে দেশপ্রেমের নিন্দা করেন। চার্লি দেশপ্রেমকে মনে করেন মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ বাড়ায়,অপর মানুষের প্রতি ঘৃণার অন্যতম কারণ এই দেশপ্রেম।
চার্লির আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে আমেরিকার পত্রিকাগুলিতে,সরকারের প্রশাসনে তখন ব্যাপক পরিমানে নাৎসীবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে।এরাই নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে।চার্লি বারবার যখন আবেদনে বলছেন,এই মহাযুদ্ধে সোভিয়েতের পতন হয়ে যদি হিটলারের জয় হয় তবে সমস্ত মানব সভ্যতার পক্ষে সেটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।তাই এই মুহূর্তের আবশ্যিক কর্তব্য নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে সোভিয়েতের সমর্থনে দাঁড়ানো।চার্লির এই ভাষ্যকেই আমেরিকার কর্তৃপক্ষ,পত্রিকাগুলি চার্লির দেশপ্রেমকে নিয়ে , নাগরিকত্বের প্রশ্ন নিয়ে আক্রমন শুরু করে।
কারণ তাঁর সিনেমা মসিয়ে ভের্দুর আলোচিত বক্তব্য ছিল , একজন দুইজনকে হত্যা করলে তাঁকে রাষ্ট্র,সমাজ খুনী হিসাবে ফাঁসি দেবে, কিন্তু কোনো যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করলে তাঁকে রাষ্ট্র,সমাজ বীর হিসাবে সম্মান করবে।
চার্লি নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন ।নিজেকে বিরাট দেশপ্রেমিক হিসাবে তুলে ধরার কোন চেষ্টা করলেন না।আমেরিকার নাগরিকত্ব নেবার কোনও চেষ্টাই করলেন না। আমেরিকা থেকে গোপনে সপরিবারে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। সেখান থেকে সুইজারল্যান্ড। আমৃত্যু সুইজারল্যান্ডে থেকেছিলেন কোনো দেশের নাগরিক না হয়ে। বিশ্বের সমস্ত মানুষকে ভালবেসে গেছেন তাঁর চলচ্চিত্রে , বাস্তব জীবনে, দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে চিরকাল সরব থেকে।
শত বছরের রক্তের হোলি খেলা বন্ধ হউক। যোদ্ধার চেয়ে ও যুদ্ধে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ, নারী, শিশু, ও বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী । সুন্দর একটা যুদ্ধবিহীন পৃথিবীর জন্য স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যেমন জরুরী তেমনি জরুরী এই যুদ্ধের অবসান।
(তথ্যসূত্রঃ অনলাইন)
মেসেঞ্জার/জুয়েল/আজিজ