ঢাকা,  শনিবার
২৭ জুলাই ২০২৪

The Daily Messenger

কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় গরু মোটাতাজাকরণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মানুষ

এম. সাইফুল ইসলাম, ঢাকা  

প্রকাশিত: ১৫:০৫, ২৫ মে ২০২৪

কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় গরু মোটাতাজাকরণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মানুষ

ছবি : ডেইলি মেসেঞ্জার

# কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে গরু
#  মাংস গ্রহণে মানুষের লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও 
   ত্বক ক্ষতিগ্রস্থের পাশাপাশি হরমোনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে 
# স্বাভাবিক উপায়ে মোটাতাজাকরণের পরামর্শ বিশেজ্ঞদের

কোরবানী ঈদকে সামনে রেখে দেশের খামারিরা এখন ব্যস্ত গরু মোটাতাজাকরণে। এক্ষেত্রে বেশি লাভের আশায় দেশের প্রান্তিক খামারিদের অনেকে গরুর শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। স্থানীয় অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে তারা ডেক্সামেথাসন বা ডেকাসন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করছেন। যেকারণে গরুর কিডনি ও লিভারের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে শরীর থেকে পানি বের হতে না পেরে গরু ফুলে ফেঁপে বড় দেখা যায়। স্টেরয়েড জাতীয় এসব রাসায়নিকের ব্যবহারে গরু মোটা দেখা দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে মাংস খুব একটা বাড়ে না। 

প্রাণী গাবেষকরা বলছেন, স্টেরয়েড জাতীয় পদার্থ গ্রহণে গরুর কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে অনেক সময় মারা যায়। পাশাপাশি রাসায়নিকে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে মানবদেহে সরাসরি ক্ষতিকর স্টেরয়েডের প্রভাবে মানুষের শরীরের নানান রোগ দেখা দিতে পারে। যার মধ্যে লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত, ত্বকের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট এবং হরমোন জাতীয় রোগ অন্যতম।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন কোরবানীকে ঈদকে সামনে রেখে খামারিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন গরু মোটাতাজাকরণে। মোটাতাজা গরুর মধ্যে পাবনা ব্রিড, অস্ট্রেলিয়ান-ফিজিয়ান ব্রিড, ইন্ডিয়ান হরিয়ানা ব্রিড, পাকিস্তানি সাহিয়াল ব্রিড, হেমাটোপিনসহ কিছু পরিচিত জাত বেশি। এর পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় ব্রিডিং পদ্ধতি, যা লোকাল ক্রস ব্রিড নামে পরিচিত। সারাবছর গরু পালন করলেও কোরবানীকে তারা টর্গেট করে বেশি লাভের আশায় থাকেন খামারি। যেকারণে কোরবানীর আগে তারা গরু মোটাতাজাকরণে একটু বেশি নজর দেন। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় অনভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকেরা ফায়দা নিতে খামারিদের নানা পরামর্শ দেন মোটাতাজাকরণে। তারা অল্প দিনে পশু মাংস বাড়ানোর কথা বলে নানা রাসায়নিকের প্রয়োগ শুরু করেন গুরুর শরীরে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মোটাতাজাকরণে উদ্বুদ্ধ করলেও অনেকে দ্রুত ফল পাওয়ার আশায় গরুকে বড়ি খাওয়ায়। অভিযোগ রয়েছে, এই বড়ি ভারত ও পাকিস্তান থেকে অবৈধভাবে আমদানি করে বিভিন্ন ওষুধের দোকানসহ গো-খাদ্য বিক্রেতাদের দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ডেক্সামেথাসন বা ডেকাসন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। 

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুকে স্বীকৃত ফর্মুলা অনুসারে খাদ্য দিয়ে মোটাতাজা করলে তার মাংস ক্ষতির কারণ হয় না। কিন্তু স্টেরয়েড দিয়ে মোটা করা গরুর মাংস ক্ষতিকর। স্টেরয়েড মূলত হাঁপানির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ জাতীয় ওষুধ অতিরিক্ত মাত্রায় দিলে গরুর কিডনি ও লিভারের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ায় শরীর থেকে পানি বের হতে পারে না। এ কারণে শোষিত হয়ে পানি সরাসরি গরুর মাংসে চলে যায়। ফলে গরুকে মোটা দেখায়।

এ বিষষে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) পরিচালক (গবেষণা) ড. নাসরিন সুলতানা দ্য ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, গরু মোটাতাজাকরণ প্রাকৃতিক এ পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে গরু মোটাতাজা করে হাজার হাজার বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ এ জন্য গরুচাষিদের দুই থেকে আড়াই কেজি বিশেষ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত ইউরিয়া, লালিগুড় ও খড়ের একটি বিশেষ ধরনের মিকচার খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়। আট দিন কোনো পাত্রে এ মিকচার বন্ধ করে রেখে তা রোদে শুকিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়। তিন মাস ধরে এটা খাওয়ালে গরু খুব দ্রুত মোটাতাজা হয়ে ওঠে। অথচ কিছু পশুচিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত মোটাতাজা করতে ক্যাটাফস, বার্গাফ্যাট, বায়োমিঙ্গ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। যা খামারির জন্যে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনেক খামারির গরু এসব খাওয়ানোর ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে যারা গেছে। 

ঢাকার পাশর্^বর্তী ধামরাইয়ে সমাজ ও জাতি গঠন (সজাগ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতায় প্রতি বছর কোরবানী ঈদের পর গরু কিনে খামারিদের মাঝে বিতরণ করে। এবারো ৫ হাজারের বেশি গরু খামারিদের কাছে দেয়া রয়েছে প্রতিষ্টানটির। সজাগের পরিচালক আব্দুল মতিন দ্য ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, না বুঝে অনেক খামারি স্টরয়েড জাতীয় ওষুধ গরুকে প্রয়োগ করে। যার ফলে, গরুর কিডনী ও লিভার নষ্ট হয়ে গরু মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় খামারি। তার প্রতিষ্ঠানের কোন খামারিকে তিনি স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণে অনুউৎসাহিত করে থাকেন। 

শেরে বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের এনিমেল সায়েন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ডিন এবং মেডিসিন এন্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কে. বি. এম. সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত বিক্রয়যোগ্য গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ কাজে স্টেরয়েড আইটেমের ডেক্সামেথাসন গ্রুপের বিভিন্ন ইনজেকশন প্রয়োগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া ইউরিয়া খাওয়ানো হয়। মুখেও বিভিন্ন ধরনের উচ্চ মাত্রার ভিটামিনের মিশ্রণ খাওয়ানো হয়। এর ফলে, বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্থ হয় গরু। কারণ, একটা সময় কিডনি ও লিভারের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট হয়ে গরু মারা যায়। না বুঝে এ ধরণের রাসায়নিক প্রয়োগে অনেক গরু মারা যাওয়ায় অনেক খামারি পথে বসে গেছে। কোরবানির আগে এ প্রবণতা বেড়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, স্টেরয়েযুক্ত মাংস গ্রহণ করলে মানব শরীরে নানান ধরণের সমস্যা দেখা দেতে পারে। এ মাংস গ্রহণের ফলে লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত, ত্বকের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট এবং হরমোন জাতীয় রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি ত্বকের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট করে দেয়। 

খামারিদের উদ্দেশ্যে এই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ হচ্ছে, বেশি লাভারে আশায় এ দরণের তৎপরতা থেকে দুরে সরে থাকা। স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক উপায়ে সঠিকভখাবে পরিচর্যা করলে পশু পালন করে লাভবান হওয়া সম্ভব। 

মেসেঞ্জার/সজিব