ঢাকা,  শনিবার
২৭ জুলাই ২০২৪

The Daily Messenger

বঙ্গবন্ধুর জুলিও-কুরি শান্তি পদক ও বিশ্ব শান্তি ভাবনা

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ২৩ মে ২০২৪

আপডেট: ১১:১০, ২৩ মে ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর জুলিও-কুরি শান্তি পদক ও বিশ্ব শান্তি ভাবনা

ছবি : মেসেঞ্জার

বিশ্ব ব্যবস্থা বলতে যেটি আমরা বুঝি সেটি কখনোই পুরোপুরি ন্যায্য নয়। বিশ্ব আজ নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আধিপত্যবাদের নিকট জিম্মি। তারা কোনো ঘটনাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন সেভাবেই বাকি বিশ্ব মিনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের দুটি শহরে পারমাণবিক বোমা হামলাকারী দেশ আজ বিশ্বের মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে পরিণত হয়েছে এই আধিপত্যবাদ দিয়ে। ইউক্রেনে যখন রাশিয়া হামলা করছে তখন পাশ্চাত্যের নিকটে এটি অন্যায্য। তারা যে যেভাবে পারছেন আক্রান্ত দেশ হিসেবে ইউক্রেনকে সহায়তা করছেন।

অপরদিকে ইজরায়েল যখন গত ছিয়াত্তর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে এবং গত ৭ অক্টোবর থেকে ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে তখন এই পাশ্চাত্য আক্রমণকারী ইজরায়েলকে অস্ত্র ও বোমা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই বিশ্ব পরিচালিত হয় ক্ষমতাবানদের বিশেষ চশমা দ্বারা। তারা যখন যেটিকে ন্যায্য বলবেন তখন সেটি ন্যায্য হবে যখন যেটিকে অন্যায্য বলবেন তখন সেটি অন্যায্য হিসেবে ভূষিত হবে। এ বিশ্বকে ন্যায্য বানাতে যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ ভূমিকা রাখেন তাদেরকে আমরা বিভিন্নভাবে স্মরণ করি। ১৯৭২ সালের ২৩ মে এশীয় শান্তি সম্মেলনে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি রমেশচন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক পরিয়ে দেন। 

বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মেরি কুরির ছাত্র ফ্রেডরিখ জুলিও কুরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর আগ্রাসন প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এর ভয়াবহতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালে প্যারিসে গঠন করেছেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ। তারা ১৯৫০ সাল থেকে প্যারিসে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার প্রদান করা শুরু করেন। প্রথমদিকে বিভিন্ন জাতির মধ্যে শান্তিতে অবদান রাখে এমন আর্ট, সাহিত্য, ফিল্ম, শিল্পের জন্য পদক প্রদান শুরু হয়। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পদকটির নাম ছিল বিশ্ব শান্তি পুরস্কার। ১৯৫৮ সালে ফ্রেডরিখ জুলিও কুরি মৃত্যুবরণ করায় পরের বছর থেকে  তার সম্মানে বিশ্ব শান্তি পদকটি Jolliot-Curie Medal of Peace বা জুলিও কুরি শান্তি পদক নামে নামকরণ করা হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদ স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদেশ নীতির সমর্থক ছিল। বিশ্ব শান্তি পদক প্রাপ্তদের মধ্যে কেহ কেহ পরবর্তীতে লেনিন শান্তি পুরস্কারও পেয়েছেন। 

বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্বশান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুকে এই পদক প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও-কুরি পদক প্রদানে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি রমেশ চন্দ্র। ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এই পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশ্বের যেসমস্ত ব্যক্তি এই পদক পেয়েছেন সকলেই অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ, ইয়াসির আরাফাত, হো চি মিন প্রমুখ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য এই ব্যক্তিবর্গকে জুলিও-কুরি পদক প্রদান করা হয়েছিল। 

বঙ্গবন্ধু বিশ্বে এমন এক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন যারা নিজস্ব স্বকীয়তা ভুলতে বসেছিলে পরাধীনতার সংস্কৃতিতে। বাঙালি জাতির প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অনন্য ভূমিকা ছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে তিনি কারাগারে অনশন করেন। বাঙালি জাতিকে ন্যায্যতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করতে গড়ে তুলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন অনেক আগে থেকেই। ১৯৫২ সালে চিনে অনুষ্ঠিত ‘পিস কনফারেন্স অব দা এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজওন্স’ এ যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। এ কনফারেন্সে ৩৭ টি দেশ থেকে আগত শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনেও অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বশান্তি প্রসঙ্গে ভাবনা ছিল সার্বজনীন।

তিনি বিশ্বের যেকোনো জায়গায় নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতার সংগ্রামী মানুষের পক্ষে অবস্থান নিতে দ্বিধা করতেন না। সকল নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থা নিলেও নিজ দেশে নিজ জাতির উপরে সংঘটিত বৈষম্যমূলক আচরণ ও গণহত্যা ঠেকাতে পারেন নি। পাকিস্তানি কারাগারের অন্তরাল থেকে শুনেছেন বাঙালি জাতির উপরে ভয়াবহ গণহত্যার কথা। 

বঙ্গবন্ধু মানুষের নিদারুণ কষ্টকে উপলব্ধি করতে পারতেন। তিনি ছাত্রজীবনে একটি দুর্ভিক্ষ দেখেছেন। সেই দুর্ভিক্ষে জনগণকে ক্ষুধার কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য লঙ্গরখানা পরিচালনা করেছেন। তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের কল্যাণে ব্যয়ের দাবি করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে তিনি একটি ক্ষুধা ও দরিদ্র মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। বিশ্ব দুটি ব্লকে ভাগ হয়ে রাজনীতি করলেও তিনি দেশের কল্যাণের জন্য সকলের সাথে সম্পর্ক রেখে কাজ করা শুরু করেন। বাংলাদেশকে নিজের শক্তিতে দাঁড় করানোর জন্য বঙ্গবন্ধু কোনো ব্লকে যুক্ত হতে চান নি।  তিনি যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মুক্তিযুদ্ধকালীন উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন, ভারতের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছেন তেমনি পাশ্চাত্যের সাথেও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের বৃহৎ স্বার্থে। তিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পররাষ্ট্রনীতিতে তার লক্ষ ছিল সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে দেশের ও বিশ্বের মানুষের কল্যাণে কাজ করা। 

তিনি শুধু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিয়েছেন এমনটি নয়। তিনি নিপীড়িত মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের ন্যায্য অধিকারকে সমর্থন করার বিষয়টিকে সাংবিধানিক আইন বানিয়েছেন। আমরা যদি ক্ষমতায় আসার পূর্বের বঙ্গবন্ধুকেও বিবেচনা করতে যাই তাহলে দেখব ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ যখন ব্যাপকভাবে জয়ী হয় তখন তিনি জাতীয় পরিষদে সংখ্যালঘুদের এই বলে আশ্বস্ত করেন যে কোনো একজনও যদি ন্যায্য কথা বলে তাহলে তারা তার সমর্থন করবেন। পৃথিবীতে সংসদে জয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠরা পরাজিত সংখ্যালঘুদের সাথে সংলাপে বসার নজির খুবই কম। এই উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন কেন? কারণ যাতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কোনো অধিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। 

বঙ্গবন্ধু সারাবিশ্বের মুক্তিকামী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তার এই উদারচিত্ত অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মত নেতা। বর্তমানে তার দেখানো পথে তাঁর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা একইভাবে বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, গণহত্যা স্বীকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মিয়ানমারের গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ লাঘবে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন তাদের জীবন-যাপন সহজ করার এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের নিজ বাসভূমে ফেরত পাঠানোর চেষ্টাও করছেন নিরন্তর। পাশ্চাত্যের প্রবল চাপ সত্ত্বেও ইজরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের উপরে গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে ফিলিস্তিনের পক্ষে সাহসী অবস্থা নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লড়াইকে অগ্রসর করেছেন তিনি। বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে জুলিও-করি পদক প্রদানের এই দিনে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার সকল অগ্রদূতকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। 

লেখকঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ও বিডিইউ ক্যারিয়ার সেন্টার (বিসিসি) এর পরিচালক (অঃ দাঃ) 

মেসেঞ্জার/দিশা