ঢাকা,  রোববার
২২ জুন ২০২৫

The Daily Messenger

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের অপেক্ষায় 

জাতীয় দলে ডাক পেলেন দিপু 

কাউছার আলম, পটিয়া (চট্টগ্রাম)

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ৬ জুন ২০২৩

আপডেট: ১৫:৫০, ৬ জুন ২০২৩

জাতীয় দলে ডাক পেলেন দিপু 

ছবি : টিডিএম

ঘরোয়া ক্রিকেটে আধিপত্য দেখিয়েই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন চট্টগ্রামের পটিয়ার ছেলে সাহাদাত হোসেন দিপু। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট এ দলের হয়ে দ্বিতীয় আনঅফিসিয়াল টেস্টে ৭৩ ও ৫০ রানের ইনিংস খেলেন দিপু। ওই টেস্ট চলাকালীন সময়ে নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন দিপুকে নিয়ে বলেছিন, লঙ্গার ভার্সনে যেরকম ব্যাটিং করতে হয়, দিপুকে দেখে ওইরকম মনে হয়েছে। ভেরি অর্গানাইজড, টেকনিকেও বেশ ভালো। তিনি পাশাপাশি মনে করিয়ে দেন, কঠিন উইকেটেও দারুণ খেলেছেন দিপু । উইকেটটা কিন্তু অত সহজ ছিল না। কারণ, সিলেটে দুই ম্যাচেই ৬ মিলি গ্রাস রেখেছি। বেশ সিমিং কন্ডিশন। এই কন্ডিশনে কে কেমন ব্যাটিং করে দেখার বিষয় ছিল।

শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ দলের বিপক্ষে সিরিজ নয়, ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করেছেন দিপু। ২০ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ২ সেঞ্চুরিতে ৩৬.১৪ গড়ে করেছেন ১২৬৫ রান। দিপুর এই পারফরম্যান্সও নির্বাচকদের নজরে পড়েছে। এরই ফলস্বরূপ জাতীয় দলে ডাক পেলেন তিনি। ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের সপ্তম সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের অপেক্ষায় এখন দিপু।

এই তরুণ ক্রিকেটারকে নিয়ে আশাবাদী প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। সোমবার দল ঘোষণার সময় দেওয়া এক বিবৃতিতে নান্নু বলেন, দিপু অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে খেলেছে। এরপর আমাদের হাই পারফরম্যান্স বিভাগে ছিল। এ দলের হয়ে সে যথেষ্ট ভালো করেছে। আমরা আত্মবিশ্বাসী, সুযোগ পেলে দিপু আরো ভালো ক্রিকেট খেলবে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে দিপু নিজেকে শানিত করে এখন জাতীয় দলের স্বপ্নের মঞ্চে সাহাদাত হোসেন দিপু। সোমবার প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের সঙ্গে অনুশীলনও করেছেন তিনি। অনুশীলন শুরুর আগে সিনিয়র সতীর্থ থেকে শুরু করে কোচিং স্টাফ সবার ভালোবাসায় সিক্ত হন দিপু। 

এমন উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে প্রতিযোগিতার মঞ্চে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চান দিপু। অনুশীলন শেষে গনমাধ্যমকে দিপু বলেন, আমি প্রতিনিয়ত নিজের স্কিল আরও উন্নত করার চেষ্টা করব। মানসিকভাবে আরও শক্ত হওয়ার চেষ্টা করব। এটাই আমার কাজ। এসব কাজে যত উন্নতি করব, আমার জন্য খেলাটা আরও সহজ হবে আমি মনে করি।

সম্প্রতি শেষ হওয়া ওয়েস্ট‘এ দলের বিপক্ষে সিরিজে বাংলাদেশ এ হয়ে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন দিপু। সময়োপযোগী ব্যাটিংয়ে নির্বাচকদের তাঁকে ভাবতে এক প্রকার বাধ্যই করেছেন। ওয়েস্ট এ দলের বোলারদের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা জানিয়ে দিপু আরো বলেন, তাদের বোলাররা একটু কঠিন। ভালো অভিজ্ঞতা ছিল। সবাই আন্তর্জাতিক মানের বোলার যারা এ দলে খেলেছে। ভারতেও মোটামুটি ভালো বোলার ছিল। এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য থাকতে হয়, মানসিকভাবে অনেক শক্ত থাকতে হয়। তা যদি মানিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে সাফল্য আসবেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় দলে অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা পটিয়ার ছেলে দিপু।

এ সাহাদাত হোসেন দিপু অনেকের কাছে অপরিচিত ছিলেন। ২০২০ সালের অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম সারথি। বিশ্বজয় করে বাংলাদেশের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখিয়ে ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের এ খেলোয়াড়। সাহাদাত হোসেন দিপুর বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার  পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই  গ্রামে। 

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, দিপু গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও স্থায়ীভাবে থাকেননি। তার বাবা আবদুস ছবুর ছিলেন পেশায় একজন গাড়িচালক। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাড়ি চালক ছিলেন সেই সুবাদে পরিবার নিয়ে তিনি সরকারি কোয়াটারে থাকতেন। তবে বছরে কয়েকবার গ্রামে বেড়াতে আসেন তারা। ওই সময় গ্রামের কিশোরদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন দিপু। খেলতেন এলাকার মাঠে ক্রিকেটও।

দিপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেমিপাকা  ঘরে কেউ না থাকায় দিপুর দুই চাচারা পরিবার নিয়ে  নিয়ে থাকেন। এ সময় দিপুর দুই চাচী মনোয়ারা বেগম, নাসিমা বেগম বলেন, দিপু  বেশি পড়াশুনার পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট খেলায় লেগে যেত। আমরা তো গ্রামে থাকি খেলাধুলা বুঝিনা, তারপরও আমাদের পরিবারের সন্তান বিশ্বকাপ জয় করেছিল। এবার জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হচ্ছে তাতে আমাদের মন ভরে গেছে। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত।    

গ্রামের বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিপুে যে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলছেন এ খবর টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই জানে গ্রামবাসী। বিশেষ করে গ্রামের কিশোররা বেশি খবর রাখে। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকেই গ্রামের মানুষ বাজারে গিয়ে টিভিতে তার খেলা দেখেছে।

গ্রামে ঢুকতেই দেখা হয় এমদাদ, শহিদ  ও ইকবালের  সঙ্গে। তারা চারজনই চরকানাই উচ্চ বিদ্যালয়ের  শ্রেণির ছাত্র। গ্রামের ছেলের এমন কৃতিত্বে তারাও বেশ খুশি। ৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়, ৯৯ তে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। এরপর বাংলাদেশ ক্রিকেটে আরো কত সাফল্য এসেছে! সবকিছুকে চাপিয়ে গিয়েছিল ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়। প্রথমবারের মতো দেশকে বিশ্বকাপ শিরোপা উপহার দেয়া দলের অন্যতম সদস্য চট্টগ্রামের পটিয়ার  ছেলে শাহাদাত হোসেন দীপু।

২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে বাংলাদেশ যুবরা চারবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে তিন উইকেটে হারিয়ে হন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। চট্টগ্রামের পটিয়ার ছেলে দীপু স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলেছিলেন ৭৪ রানের ইনিংস। ছয় ম্যাচে এক হাফ সেঞ্চুরিসহ দীপু মোট রান করেছেন ১৩১। স্ট্রাইক রেট প্রায় ৭৪। হাঁকিয়েছেন ১১ চার ও ১ ছক্কা।

আজকের এ অবস্থানে আসার পেছনে মা ফেরদৌস বেগম, বড় ভাই আবুল হোসেন বাবু আর দুলাভাইরা  ছিলেন পাশে। প্রতিবেশী সুদীপ্ত সেসময় দিপুকে ইস্পাহানী ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তিনি সবসময় ভালো খেলার জন্য সাহস ও সমর্থন দিয়েছিলেন বলেই দিপু আজ জাতীয় দলে খেলার ডাক পেলেন। 

তবে দিপুর এতদূর আসার পথটা সহজ ছিলো না। অল্প বয়সে বাবা হারানো দিপু অনেক সংগ্রাম করে ক্রিকেট চালিয়ে গেছেন। পাড়ার বড় ভাই সুদীপ্তের সহায়তায় চট্টগ্রামের ইস্পাহানি ক্রিকেট ক্লাবে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান দিপু। কিন্তু সেই ক্লাবে মাসিক বেতন দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। তবে ক্রিকেটের প্রতি অদম্য ইচ্ছা আর একজন দক্ষ ক্রিকেটার হয়ে ওঠার স্বপ্নটা ক্লাব কর্তৃপক্ষও দিপুর চোখে দেখতে পেয়েছিল। ফলে দিপুকে বিনা বেতনে একাডেমিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয় ইস্পাহানি ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম সেনানী পটিয়ার খুদে টাইগার শাহাদাত হোসেন দিপু এবার জাতীয় দলে অভিষেকের অপেক্ষায় শুধু। বিশ্বকাপ জয়ের ফলে সারা দেশে আনন্দের যে ঝড় উঠেছিল তার ঝাপটা লেগেছিল দিপুর বাড়িতেও। ঠিক তিন বছর পর এবার অধরা স্বপ্ন দিপুকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সোমবার দিপুর জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাওয়ার খবরে আত্মীয় স্বজন, পাড়া-পড়োশি, বন্ধু বান্ধব সবাই এসে ভিড় করছে তার বাড়িতে।

দিপুর পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ছোট বেলা থেকেই সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতো দিপু। যার কারণে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় ও মনযোগ ছিল।  দিপু ৩ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। তিন বোনই বিবাহিত ও বড় ভাই আবুল হোসেন বাবু ড্রাইভিং পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। অপরদিকে দিপুর মা গৃহিনী ফেরদৌস বেগমও ছেলের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাওয়ায় মহাখুশি। দিপুর বাবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকুরির কারণে পুরো পরিবার ১৯৮৩ সালে থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ভাড়া বাসায় থাকত। বর্তমানে নগরীর কাতালগঞ্জ এলাকার একটি ভাড়া বাসায় তারা থাকেন। ২০১০ সালে শাহাদাতের পিতা দূরারোগ্য ব্যধি ক্যান্সারে  আক্রান্ত হয়ে যখন মারা যায়, তখন দিপুর বয়স আট বছর তখন   থেকেই সে ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগী হয়। 

শাহাদাত হোসেন দিপু'র মা ফেরদৌস বেগম কালের কন্ঠকে বলেন, দিপুর এই কৃতিত্বের পেছনে আমার বড় ছেলে আবুল হোসেন বাবুর অবদান সব চেয়ে বেশি। বর্তমানে দিপু শুধু আমার ছেলে নয়, সারা বাংলাদেশের ছেলে আমি তার জন্য, তার দল ও দেশের জন্য দোয়া করি। তারা যেন আগামীতে আরো এগিয়ে যেতে পারে। তারা যেমন ২০২০ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয় করেছিল। আমি দোয়া করব যেন আগামী ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করে তারা যেন ঘরে ফিরতে পারে।

আরো জানা যায়,  জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার নুরুল আবেদীন নোবেলের হাত ধরেই ক্রিকেট জগতে দিপুর পর্দাপণ। ইস্পাহানী ক্রিকেট একাডেমি থেকেই উঠে আসা দিপু এবার জয় করল বিশ্বকাপ। ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে দারুণ খেলেছেন দিপু। পাকিস্তানের বিপক্ষে পরিত্যক্ত হওয়া ম্যাচে করেছিলেন ১৬ রান। কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ৪০ রান। বাংলাদেশ দলের এই বিশ্বকাপ জয়ে পটিয়ার ছেলে দিপুর ভূমিকা ছিল দেখার মতো।

তবে ক্রিকেটের শুরুটা তার এত সহজ ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রথমদিকে পরিবারের পুরোপুরি সমর্থন ছিল না ক্রিকেট খেলায়। পরে ২০১০ সালে মারা যায় টিপুর বাবা। এই সময় পরিবারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে দীপুর বড় ভাইয়ের উপর। সেই সময় থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে দীপুর। পরিবারের নানা অস্বচ্ছলতার মধ্যে ক্রিকেট ছাড়েননি দীপু। দিপুর বড় ভাই আবুল হোসেন বলেন, এক সময় তার নিজের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ থাকলে পরিবারের কারণে আর খেলা হয়নি। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে তিনি সব সময় দীপুকে খেলার প্রতি সমর্থন দিয়ে গেছেন। নিজের ব্যাট না থাকায় শুরুতে গাছ দিয়ে ব্যাট বানিয়ে, ধার করা ব্যাট দিয়ে দীপু খেলত বলে জানান তার বড় ভাই।

তবে দীপুর এই ভাল খেলার পিছনে সবচেয়ে বড় সমর্থন ছিল তার দুই দুলা ভাইয়ের। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার করতে হয়েছে দীপুর। ছোট বেলা থেকে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পাওয়া মেডেল, ট্রফি রাখার জন্যও ঘরে কিছু ছিল না। খেলার জন্য ছিল না ভাল কোনো ব্যাট। ধার করা ব্যাট দিয়ে খেলতে হতো দিপুকে। তবে শুধুমাত্র নিজের একাগ্রতা, খেলার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষাই দীপুকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলে জানান তার বড়ভাই। সাহাদাত হোসেন দীপু বলেন, অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয় দলীয় সাফল্য। এই জন্য দুই বছর তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ভবিষ্যতে জাতীয় দলের জার্সিতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার আগ্রহ ছিল দিপুর। আর সেই অধরা স্বপ্ন পুরন হতে চলছে দিপুর। জাতীয় দলে খরলে তামিম, সাকিব কিংবা মুশফিকের মতো নিজেকে গড়ে তুলতে চান তিনি। 

টিডিএম/আরস