
ছবি : সংগৃহীত
দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরী ঋণের নামে লুট করেছেন আমানতকারীদের টাকা। নিজের নামে কিনেছেন ফ্ল্যাট ও জমি। সেই ফ্ল্যাট মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের কাছে ভাড়াও দিয়েছেন! আত্মসাতের টাকায় বানিয়েছেন উইন্ডি টেরেস হোটেল। এভাবে আত্মসাৎ করেছেন ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া ৯৯ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা দুইটি মামলা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২০ সালে দায়ের করা মামলা দুইটির তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের খুঁটির জোর এতই শক্ত যে, তদন্তকালে রেকর্ডপত্র জব্দ করায় তাদের তদবিরে দুদকের এক উপপরিচালককে প্রধান কার্যালয় থেকে একটি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়। আরেকটি মামলার তদন্তকারীকে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ধীরে চল নীতিতে তদন্ত করতে বলেছেন।
৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলাটি ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দায়ের করেছিলেন উপপরিচালক সালাউদ্দিন। পরে আরেকজন উপরিচালককে সেটির তদন্তকারী নিয়োগ করা হয়। তাকে বদলির পর এখন অন্য একজন উপপরিচালককে তদন্তকারী নিয়োগ করা হয়েছে। মামলাটিতে চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামসুন নাহারকে আসামি করা হয়।
২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি দুদকের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজের দায়ের করা আরেকটি মামলাতে শিহান আবরার চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে অভিযোগ আনা হয়, শিহান আবরার চৌধুরীর সম্পদ বিবরণীতে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৩৪ হাজার ১৫১ টাকা কম দেখিয়ে গোপন এবং ৯৯ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। এটির তদন্ত করছেন একজন সহকারী পরিচালক।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের ৩ কোটি টাকা দিয়ে গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। সেই ফ্ল্যাট দুটি আবার মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের কাছেই প্রতিমাসে ১৫ লাখ টাকায় ভাড়া দেয়া হয়েছে। ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগ ও ঋণের টাকা পরিশোধ কোনোটিই করেননি। একইভাবে হোটেলের ক্ষেত্রেও ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগ ও ঋণের টাকা পরিশোধ কোনোটিই করেননি।
দুদক সূত্র বলছে, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের’এসওডি হিসাব থেকে ২০১১ সালের ১৪ জুলাই তারিখে আফজার হোসেন ও শাহেদা খাতুনের নামে ৩ কোটি টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের পক্ষে চেকটি ইস্যু করেন ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামসুন নাহার। ওই তিন কোটি টাকা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক প্রগতি স্মরণি শাখায় আফজার হোসেন ও শাহেদা খাতুনের নামে পরিচালিত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে একই বছরের ১৭ জুলাই নগদায়নও করা হয়।
তিন কোটি টাকার চেকের বেনিফিসিয়ারি আফজার হোসেন দুদককে জানান, গুলশানে ছয় তলাবিশিষ্ট ভবনের নিচতলায় কারপার্কিং ও কমন এরিয়াসহ ২ হাজার ১৫০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট এবং তার স্ত্রী শাহেদা খাতুনের নামে কেনা নিচতলায় কারপার্কিং ও কমন এরিয়াসহ একই ভবনের উত্তর-পশ্চিম দিকের ২ হাজার ৩৫০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটসহ দুইটি ফ্ল্যাট মোট ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকায় শিহান আবরার চৌধুরীর কাছে সাবকবলা দলিলে বিক্রি করেন। অথচ ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক থেকে দুদককে জানানো হয়, চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরীকে ওই তিন কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: রেকর্ডপত্র জব্দ করায় দুদক উপপরিচালককে বদলির অভিযোগ
ন্যাশনাল ব্যাংক গুলশান শাখায় ‘ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের’নামে পরিচালিত এসওডি হিসাব থেকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে উইন্ডি টেরেস হোটেলের নামে ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকার একটি চেক ইস্যু করা হয়। এই টাকা সিটি ব্যাংক গুলশান এভিনিউ শাখায় উইন্ডি টেরেস নামের হিসাবের মাধ্যমে একইদিন নগদায়নও করা হয়।
৬ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেকটির বেনিফিসিয়ারি উইন্ডি টেরেসের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম দুদককে জানান, তিনি ২০০৪ সালের ৪ জুন শিহান আবরার চৌধুরীর কাছে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা মৌজার ৭.৫ কাঠা ভিটি জমি বিক্রি বাবদ ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ও রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ ৮১ লাখ টাকাসহ মোট ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। জমিটিতে আটতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে পাঁচ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটিই উইন্ডি টেরেস হোটেল। কিন্তু, ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক থেকে দুদককে জানানো হয়, চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরীকে ওই ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
দুদক অনুসন্ধানকালে চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরীকে দেওয়া ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার ঋণের আবেদন, অনুমোদন ও তা পরিশোধ সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডপত্র পায়নি। দুদক বলছে সেই হিসেবে শিহান আবরার চৌধুরী চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ও এমডি শামসুন নাহারের সহায়তায় আমানতকারীদের এসব টাকা অবৈধভাবে ঋণ হিসেবে গ্রহণ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সেই টাকা দিয়ে নিজ নামে সম্পদও অর্জন করেছেন।
উইন্ডি টেরেস হোটেলের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় উইন্ডি টেরেস হোটেল, কক্সবাজারকে ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিন তারকামান লাইসেন্স দিয়েছে।
দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সূত্রে জানা গেছে, উইন্ডি টেরেস হোটেলের মালিক এখন আবু জাফর চৌধুরী। তিনি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের চিফ কাস্টডিয়ান। তিনি শিহান আবরার চৌধুরীর বাবা। শিহান আবরার চৌধুরী এখন কানাডায় থাকেন। আগে তিনি এটির মালিক ছিলেন। আর ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ২০২০ কিংবা ২০২১ সালের প্রথম দিকে মারা গেছেন।
দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের জনসংযোগ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম তুফান দ্য ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না।’
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলমগীর মেসেঞ্জারকে বলেন, আমি তো এই বিষয়টি দেখি না। আপনি উপদেষ্টা (জনসংযোগ বিভাগ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম সামছুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলুন। তখন তার কাছে এ কে এম সামসুদ্দিনের মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি কল কেটে দেন।
প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ বিভাগের ইনচার্জ এমবি রুসলান তারিক তামভি দ্য ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, আমি যোগ দিয়েছি দুই বছরও হয়নি। আমি এসব বিষয় ডিলও করি না। আমার বস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম সামছুদ্দিন স্যার এই বিষয়ে বলবেন।’ তারপর এ কে এম সামসুদ্দিনের মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
মেসেঞ্জার/দিশা