বরগুনা নদীমাতৃক একটি জেলা। চারদিক থেকেই অজস্র ছোট-বড় নদী ও খাল জেলাটিকে ঘিরে রেখেছে। ফলে একটা সময় এই জেলার মানুষজন রাজধানী ঢাকা বা বিভাগীয় শহর বরিশালে যেতে সড়কপথ ব্যবহার করতো খুবই কম। ওই সময় জলপথকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো বেশি। কিন্তু মধ্যযুগীয়ভাবে নদীপথে বরগুনা থেকে বরিশাল যেতেই সময় লাগতো প্রায় ১২-১৩ ঘণ্টা, আর ঢাকা যেতে লাগতো প্রায় ৩০ ঘণ্টা। তাদের যাতায়াতের আরেকটি মাধ্যম ছিল পায়রা নদী পার হয়ে আমতলী গিয়ে সেখান থেকে বরিশাল যাওয়া, তবে বরগুনা-বেতাগীর মানুষদের জন্য সেটা ছিল চরম কষ্টসাধ্য।
আমার প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন নেত্রী জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কথা হচ্ছে, একটি এলাকার উন্নয়নের প্রথম শর্ত সেই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা। তার ভাবনাই আমার ভাবনা। তাই আমিও প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরে আমার এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। ফলে আমি আমার নির্বাচনী অঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় প্রচুর রাস্তাঘাট পাকা করেছি।
১৯৯১ সালে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে আমার লক্ষ্য ছিল বরগুনা জেলার সাথে ঢাকায় সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা বরগুনা-বেতাগী-বাকেরগঞ্জ মহাসড়কটি নির্মাণ করার। এটি তখন সাধারণ একটি মাটির রাস্তা ছিল। তাই আমি জোর প্রস্তাব রাখি— এই সড়কটিকে পাকা সড়কে রূপান্তরিত করার। যাতে এই সড়কটি ব্যবহার করেই আমার অঞ্চলের মানুষজন বিভাগীয় শহর বরিশাল ও রাজধানী ঢাকায় যেতে পারে। কারণ, আমাদের বরগুনা বঙ্গোপসাগরের একেবারে নিকটবর্তী যেমন তেমনই ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ও বরিশাল থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর বরগুনা থেকে বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি প্রায় ৫৭ কিলোমিটার পথের। রাস্তাটি বাকেরগঞ্জে গিয়ে ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটার জাতীয় মহাসড়কে মিশেছে। শুধু এই একটি রাস্তার অভাবে আমার অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ সড়কপথে বরিশালে যেতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তো।
তাই ১৯৯১ সালে আমি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই সংসদে তৎকালীন বিএনপি সরকারের কাছে রাস্তাটি করে দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাই। আমি সংসদে তাদের বলি, সত্যিকারভাবে সরকার যাতে রাস্তাটিকে গ্রহণ করে, সেজন্য বরগুনার মানুষও অবদান রেখেছেন। তাদের আরও বলি যে, এই রাস্তার মাটির কাজ করতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কোনো পয়সা লাগবে না। এ ছাড়াও এ রাস্তার ব্যাপারে কোনো ভূমি হুকুম দখল করতে হবে না। কারণ, এলাকার মানুষ এই রাস্তার জমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের জীবনের পরিবর্তনের জন্য, তাদের একটি স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি বরগুনা, বেতাগী, বাকেরগঞ্জের তৎকালীন উপজেলা পরিষদসমূহ ও ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তারা এলাকার সমস্ত উন্নয়নের গম এবং খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে এই রাস্তার সমস্ত কিছু শেষ করেছেন।
এসব কথা আমি সংসদে উত্থাপন করার পাশাপাশি ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমেদকে ১৯৯১ সালের ২৫ মে একটি ডিও লেটার দেই। তার সঙ্গে দেখাও করি। তিনি সেটাকে রিপোর্টের জন্য রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে পাঠান। চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ১৯৯১ সালের ৪ আগস্ট একটি সুপারিশ দেন যে, রাস্তাটি গুরুত্বের দিক থেকে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। সুতরাং অতিরিক্ত টাকা এবং গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করা যায়।
ওইসময় নেদারল্যান্ডস সরকার দক্ষিণাঞ্চলের রাস্তাঘাটের উন্নয়নের জন্য ১০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। আমার এই সমস্ত যুক্তির কারণে বিএনপি সরকার রাস্তাটি করার জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েও কিছুদিন পরে অদৃশ্য কারণে তা আবার বাতিল করে দেয়। এই বরাদ্দ বাতিলের পরেও আমি তাদেরকে বলি যে, রাস্তাটা কার্পেটিং করতে হবে না। আপনারা শুধু কালভার্ট ও ছোটখাটো ব্রিজ যেগুলো লাগবে, সেগুলো করে দেন। তাহলে এই কাঁচা রাস্তা দিয়ে বরগুনার মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। তারা সেটাও তখন করে দেয়নি। হয়তো আমি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বা আওয়ামী ভোটার অধ্যুষিত এলাকার উন্নয়ন তারা চায়নি। এ কারণেই তারা বরাদ্দ দেয়নি।
তবে ১৯৯৬ সালে আমি মন্ত্রী হওয়ার পরে সরকার ও ডানিডার যৌথ অর্থায়নে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করে এই রাস্তাটাকে আঞ্চলিক মহাসড়কে উন্নীত করি। এ রাস্তাটিতে অনেকগুলো ব্রিজ, কালভার্ট অন্তর্ভুক্ত ছিল— যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিয়ামতি ব্রিজ, পুটিয়াখালী ব্রিজ, ঝোপখালী ব্রিজ, কাউনিয়া ব্রিজ ও বরগুনার খাকদোন নদীর উপর একটি ব্রিজ। রাস্তার সঙ্গে এগুলোও নির্মাণ করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তখন এ কাজে আমাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন। এই কাজগুলোর শতকরা ৯০ শতাংশ আমি মন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই শেষ করে যেতে পেরেছিলাম। অল্প কিছু কাজ বাকি ছিল, যেটা ষড়যন্ত্র করে ২০০১ এর নির্বাচনে আমাদের সরকারকে ও আমাকে পরাজিত করার কারণে আমি শেষ করে যেতে পারিনি।
তবে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে একটা শ্রেণি দলবেধে নামলো। এদের কাজ ছিল বরগুনার উন্নতির জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে যেসব উন্নয়নমূলক কাজ এনেছিলাম, এর ভেতরে যেগুলোর কাজ পুরোপুরি শেষ করে যেতে পারিনি, কিছু কাজ তো বাকি ছিল, সেসব বাকি কাজের বিরোধিতা করা। বিরোধিতার নমুনা কেমন ছিল ছোট একটা উদাহরণ দেই। বরগুনা-বাকেরগঞ্জ মহাসড়কের বরগুনা টাউনহলের সামনের যে ব্রিজটা, ওই ব্রিজটাতে অর্থায়ন করেছিল ডানিডা। রাস্তার বেশিরভাগ কাজ আমি শেষ করে গেলেও এ ব্রিজটার কাজ শেষ করতে পারিনি। তবে এটা কোথায় হবে, কারা অর্থায়ন করবে— এই কাজগুলো ঠিক করে গিয়েছিলাম। আমি মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ জেলার সমস্ত শ্রেণিপেশার মানুষকে সার্কিট হাউজে দাওয়াত দিয়ে তাদের মতামতের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করেছিলাম। সে মিটিংয়ে ডানিডার বাংলাদেশের তৎকালীন কান্ট্রি হেড এবং এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী— এরাও উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিজটা যেন এখান থেকে না হয়ে আরও দেড়-দুই কিলোমিটার পূর্ব দিক থেকে হয় সেজন্য একটা পক্ষ ঢাকা গিয়ে ডানিডার হেড অফিস ও দূতাবাসে জোর তদবির শুরু করেন। তারা এমন জায়গায় ব্রিজটা করতে চেয়েছিলেন যেটা মূল রাস্তা থেকে অনেক দূরে। বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলে গুটিকয়েক অসাধু ব্যক্তি, যারা বরগুনার ভালো সহজে সহ্য করতে পারে না, তারা এসব কাজের নেতৃত্ব দিলেন। কিন্তু ডানিডার তৎকালীন কান্ট্রি হেড যে ছিলেন ওই ভদ্রলোকের দৃঢ় ভূমিকার কারণে তাদের সেই প্রচেষ্টা তখন সফলতা দেখেনি। তখন তিনি বলেছিলেন, এটা তো মন্ত্রী মহোদয়কে নিয়ে প্রকাশ্য মিটিংয়ে সকলের মতামত নিয়ে আমরা ঠিক করেছি, এটা আর পরিবর্তন করা যাবে না। পরবর্তীতে ২০১৪-২০১৮ সালের সময়কালে ১১৪ কোটি টাকা বরাদ্দে রাস্তাটিকে আরও প্রশস্ত করে আমি এটার সমূহ উন্নয়ন করে রাস্তাটিকে আঞ্চলিক মহাসড়কে উন্নীত করি।
আপনারা অবগত আছেন, পায়রা ও বিষখালী নদীতে খুব শিগগিরই ব্রিজ নির্মিত হবে। পায়রা নদীতে হবে আগে। এরই মধ্যে পায়রা নদীর আমতলী-পুরাকাটা পয়েন্টে জমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক কাজও শেষ করা হয়েছে। যদিও করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্রিজের ভৌত অবকাঠামোগত কাজ শুরু হতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে সেটাও খুব দ্রুতই শুরু হবে। ব্রিজের কানেক্টিং রোড হিসেবে অল্পদিনের মধ্যেই প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ রাস্তাটিও ফোর লেনে রূপান্তরিত হবে। যার ধারাবাহিকতায় বরগুনার সড়ক বিভাগ হতে ডিপিপি প্রস্তুত করে পাঠাতে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই ডিপিপি অনুমোদনের পর রাস্তাটি ফোর লেনে উন্নীত করতে জমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হবে। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বেশ আগেই আমার প্রস্তাবের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। এ মহাসড়কটির বেতাগী থেকে আরেকটি অংশ যেটি বেতাগী থেকে নিয়ামতি হয়ে বাকেরগঞ্জে মিশেছে সেই সড়কটিও প্রশস্তকরণ ও মজবুতীকরণ করা হবে দ্রুতই।
এই ব্রিজটি ও রাস্তাটি ফোর লেনে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে আমার ও আমার এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত একটি স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। যে স্বপ্ন আমার এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন দেখেছে ও তাদের প্রতিনিধি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি অবগত করেছি এবং তার সদয় সম্মতি আদায় করতে সমর্থ হয়েছি। এখন কেবল অপেক্ষা আমার বরগুনাবাসীর আজন্ম লালিত এ স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন দেখার।
লেখক: সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং সভাপতি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
মেসেঞ্জার/আল আমিন