ঢাকা,  সোমবার
২৯ এপ্রিল ২০২৪

The Daily Messenger

কুষ্টিয়ার শহিদ বুদ্ধিজীবী আবুল হাশেম সরকার অভিষিক্ত বিনম্র শ্রদ্ধায়

সেলিম রেজা

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১২:১৫, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

কুষ্টিয়ার শহিদ বুদ্ধিজীবী আবুল হাশেম সরকার অভিষিক্ত বিনম্র শ্রদ্ধায়

ছবি : সংগৃহীত

শহিদ বুদ্ধিজীবী আবুল হাশেম সরকারের জন্ম কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুর গ্রামে। ১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। মেধাবী শিক্ষক আবুল হাশেম সরকার এসএসসি থেকে এমএড (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়) পর্যন্ত সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। তৎকালীন কুষ্টিয়া কলেজের (১৯৫২-৫৬) ছাত্র থাকাকালীন সর্বত্র ‘ব্ল্যাক জুয়েল’ নামে পরিচিত ছিলেন। আবুল হাশেম সরকার ১৯৫৭-১৯৭১ সময়ে বাগোয়ান কেসিভিএন স্কুল (কুষ্টিয়া), শাহীন স্কুল (ঢাকা), তুজলপুর হাইস্কুল (সাতক্ষীরা) এবং আজিমপুর গার্লস স্কুলে (ঢাকা) শিক্ষকতা করে প্রশংসিত হন। মেহেরপুরের গাংনী থানা শহরবাসীর অনুরোধে আবুল হাশেম সরকার দু’বার ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ গাংনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অনুজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক মো. মাহাতাব উদ্দিন সরকার স্মৃতি কথায় (১৯৮৬) লিখেছেন, আবুল হাশেম সরকার গাংনী হাইস্কুলে যোগদানের পর স্কুলটি নবযৌবন লাভ করে এবং অচিরেই সকলের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এমন সময় শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এবং মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও ক্যাপ্টেন (অনা.) তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় এবং নির্দেশনায় তিনি এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

মেহেরপুর জেলার গাংনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক এবং আবুল হাশেম সরকারের ছাত্র মো. আব্দুল গণি তার স্মৃতিকথায় (২০০৪) বলেছেন, ‘১৯৬৭ সালের শুরু থেকে বিদ্যালয়ের চেহারা পাল্টে গেল। ক্লাসসহ তার (হাশেম স্যার) এডমিনিস্ট্রেশন না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না। পরবর্তীকালে তৎকালীন গাংনী সিও ছিলেন স্কুলের সভাপতি। অনেক প্রধান শিক্ষক সিও সাহেবকে স্যার বলে ডাকতেন, কিন্তু আমার স্যারকে কোনোদিন সিও সাহেব ছাড়া ডাকতে শুনিনি। এমনকি স্কুলের বিলে সভাপতির অফিস নয়, বিদ্যালয়ের অফিসে বসে সই করাতেন, সিও অফিসে নয়।...হানাদার বাহিনীর আগমনের আগেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তিনিও ভারতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওঁৎ পেতে থাকা শত্রুরা তাকে সেখান থেকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল।... শত্রুর কালো হাতের থাবা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।... সত্যের পূজারী, নির্ভীক এই নির্দোষ প্রধান শিক্ষক হারিয়ে গেলেন অতলান্তে যার সন্ধান আজো কেউ পায়নি।’ লেখক, গবেষক ও অধ্যাপক রফিকুর রশিদ রচিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা’ (২০০৯) শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন...“স্কুলের শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য সুযোগ্য হেড মাস্টার আবুল হাশেম সরকারকে ঢাকা থেকে গাংনী হাইস্কুলে নিয়ে আসেন কয়েকবছর আগে।.... হেড মাস্টার আবুল হাশেম সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নানাবিধ সহযোগিতা করায় গাংনীর বিরুদ্ধ পরিবেশে অস্বস্তিবোধ করেন বলে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবেন।... কিন্তু স্যারের ভগ্নিপতি হাফিজ উদ্দিন বিশ্বাস তাঁকে স্কুল কোয়ার্টার থেকে নিয়ে এসে 

চৌগাছায় নিজ বাড়িতে রাখেন।... কিন্তু ১৬ আগস্ট রাতে পাক সেনারা বাড়িতে হানা দিলে কোনো ভরসাই থাকেনা অবশিষ্ট। বরেণ্য দুই শিক্ষাবিদ হাফিজ উদ্দিন বিশ্বাস এবং আবুল হাশেম সরকারকে চোখ বেঁধে বাড়ি  থেকে এনে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা গাড়িতে তুলে ফেলে....।”

কুষ্টিয়ার প্রাগপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যেগে শহিদ বুদ্ধিজীবী আবুল হাশেম সরকারের সহধর্মিণী শহিদ জায়া হাসিনা বেগমকে সম্মাননা জানানো হয়। এসময় অধ্যাপক মো. মাহাতাব উদ্দিন সরকার, অধ্যাপক মো. সফিউল ইসলামসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আবুল হাশেম সরকার তখন স্বাধীনতার পক্ষে খুব সোচ্চার। এলাকার ছাত্র-যুবকদের ডেকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বোঝাতে থাকেন। বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান দিয়ে এবং সংবাদপত্রের খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁতে যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এজন্য তিনি ৭১ এর জুলাই-আগস্টে সীমান্ত এলাকা পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় যান। সেখানে যুদ্ধ এবং শরণার্থী নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। ভারত থেকে এসে আবুল হাশেম সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জোর তৎপরতা চালাতে থাকেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সাধারণ যুবক ও ছাত্রদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলে রোকনুজ্জামান এবং বোনের ছেলে একরামুল হককে যুদ্ধে পাঠান। যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁরা শহিদ হন। এদিকে শত্রুরাও থেমে থাকেনি। এলাকার পিস কমিটির প্ররোচনায় তৈরি হত্যা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয় আবুল হাশেম সরকারের। অবশেষে আসে '৭১-এর ১৬ আগস্টের গভীর রাত। স্থানটি ছিল গাংনী থানার চৌগাছা গ্রাম। তখন আবুল হাশেম সরকার ভগ্নিপতি হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখানে হানাদার বাহিনীর গাড়ি এসে হাজির। পাকিস্তানি সৈন্য ও স্থানীয় কয়েকজন দোসর গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকে আবুল হাশেম সরকার ও হাফিজ উদ্দিন বিশ^সের চোখ বেঁধে ফেলে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িতে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আর তারা ফিরে আসেননি স্বজনদের কাছে। পরে জানা যায়, ভাটপাড়া পাকস্তানি ক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতনের পর তার লাশ কাজলা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো বটে; কিন্তু নির্ভীক, দেশপ্রেমিক, শিক্ষক আবুল হাশেম সরকার সেই স্বাধীনতার আস্বাদন নিতে পারলেন না। দীর্ঘ ৫১ বছর পর সম্প্রতি এই শহিদ বুদ্ধিজীবী আবুল হাশেম সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক স্বীকৃতি (গেজেটভুক্ত) পেয়েছেন। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী প্রাগপুর গ্রামে স্থায়ী বসবাসরত তাঁর পরিবারের সদস্যরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।

১৯৯৫ সালে গাংনী হাইস্কুলের সুবর্ণজয়ন্তীতে এ গুণী প্রধান শিক্ষককে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয়। সুবর্ণজয়ন্তী স্মরণিকা ‘উত্তরাধিকার’- তাঁকে উৎসর্গ করা হয়। ২০১১ সালে কুষ্টিয়ার ‘স্বনির্ভরতায় আশার আলো মুক্তিযোদ্ধা বহুমুখী (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অনুমোদিত) সমবায় সমিতি তাকে শহিদ বুদ্ধিজীবী সম্মাননা প্রদান করে। ২০১৫ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক, লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক বাংলাদেশ টেলিভিশনে এই শহিদ শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করেন। ২০২০ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলাধীন প্রাগপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে আবুল হাশেম সরকারকে মরণোত্তর সম্মাননা জানানো হয়। এবছর মার্চ মাসে গাংনীর ভাটপাড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা ও এলাকাবাসী তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে।

এই দেশে, এই সমাজে, প্রতিপদে, যেকোনো সংকটে-বিপর্যয়ে আবুল হাশেম সরকারের মতো গুণী শিক্ষকের বড় প্রয়োজন। তাঁকে আবারো বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। 

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক

মেসেঞ্জার/সজিব

dwl
×
Nagad

Notice: Undefined variable: sAddThis in /mnt/volume_sgp1_07/tp4l1yw3zz9u/public_html/bangla/details.php on line 700