ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

বিসিএস ক্যাডার ও তারুণ্যের চাকরি ভাবনা

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ৭ এপ্রিল ২০২৪

আপডেট: ১৯:০৮, ৭ এপ্রিল ২০২৪

বিসিএস ক্যাডার ও তারুণ্যের চাকরি ভাবনা

ছবি : ডেইলি মেসেঞ্জার

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত অবস্থায় বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ‘নিজের গ্রামকে জানো’ প্রোগ্রামের আওতায় বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সংযুক্তি নিয়ে বরিশালের একটি উপজেলায় যাই। সেখানে একটি গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সরেজমিনে সমীক্ষা করা ছিল আমাদের এই প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য। উপজেলা সদরে গিয়ে ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় পরিচয় পর্বে জানতে পারলেন আমাদের টিমের একজন বুয়েটের অ্যালামনাই। এই পরিচয় শুনে প্রথম প্রশ্ন ছিল বুয়েটে পড়ে শিক্ষা ক্যাডারে কেন আসলেন? অবশ্যই তার প্রশ্নের ভাবটা এমন ছিল সমাজ একজন বুয়েটিয়ানকে কলেজ শিক্ষক বা শিক্ষা প্রশাসনে দেখতে চান না। অবশ্য আমাদের সেই টিমমেট নেসকোর দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষায় যোগ দিয়েছিলেন। সাধারণ শিক্ষা ছিল তার প্রথম পছন্দ। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো সেবার একজন এডমিন ক্যাডারে তিন বছর চাকরি করে শিক্ষা ক্যাডারে একাউন্টিং-এর প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সম্প্রতি একজন বুয়েটিয়ানের এডমিন ক্যাডার ছেড়ে আসা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তাপ বইছে।

আমাদের গরিষ্ঠ সমাজের দর্শনটা একসময় ছিল শুধুই অর্থকেন্দ্রিক। যে যত বেশি অর্থ কামাই করতে পারতেন তিনি সমাজে ততবেশি মূল্যায়িত হতেন। এই দর্শন মোটামুটি বিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত চলমান ছিল। বর্তমানে শুধু অর্থ থাকলেই পূর্বের ন্যায় সেই মূল্যায়নটি পাওয়া যায় না। অর্থের সঙ্গে ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদা যুক্ত হলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন পাওয়া যায়। তবে অর্থবিত্ত না থাকলেও মেধার জোরে ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশের মতো ভালো কোনো জব হলেও সমাজে এখন ভালো মূল্যায়ন পাওয়া যায়। সমাজের এই দর্শনের পেছনে আমাদের প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কৃতি বেশ ভালোভাবে যুক্ত।

একজন সাধারণ নাগরিক সরকারি বা বেসরকারি সেবাকেন্দ্রগুলোতে গিয়ে প্রায়ই নাজেহাল হন। সরকারি চাকরিজীবী বা পরিবারের কেহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেই কেবল এসব জায়গায় ভালো সেবা পাওয়া যায় বলেই সাধারণের অভিজ্ঞতা। ক্ষেত্রবিশেষে স্পিড মানি বা ঘুষ দিয়ে হয়ত কিছু কাজ আদায় করা যায় তবে অনেকসময় টাকার পাশাপাশি ক্ষমতা প্রদর্শনও প্রয়োজন হয়। যেমন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টেন্ডারের মাধ্যমে যে-সব কাজ করানো হয় তার বাজেটের একটি নির্দিষ্ট অংশ কিছু দপ্তরে বা ব্যক্তিকে না দিলে সেই কাজটি হয় না বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সরকারি কিছু অফিসে কানাঘুষা আছে যে জেলার ডিসিকেও নাকি ওসব অফিসে ঘুষ দিতে হয়। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখালেও এটি আমাদের প্রশাসনিক বাস্তবতা।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী হিসেবে একজন সহকারী কমিশনার (ম্যাজিস্ট্রেট) বা পুলিশের একজন সহকারী পুলিশ সুপার জেলা পর্যায়ে বেশ ভালো এক্সপোজার পান। সরকারের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের অন্যান্য সকল দপ্তরে বেশ দাপট দেখানোর সুযোগ আছে। তার অধিক্ষেত্রের সর্বত্র তিনি দলনেতার ভূমিকা পালন করেন। এমনকি অন্যান্য দপ্তরের বেশ সিনিয়র কর্মকর্তাদেরকেও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তাকে মানতে হয়।

সম্প্রতি ৪০তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে উক্ত ক্যাডারে তার ৮০ দিনের কর্ম অভিজ্ঞতা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। তিনি তার কর্মকালে যা দেখেছেন এবং শেয়ার করেছেন তা অবশ্যই ভ্যালিড। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমরা এমনটাই শুনেছি। বর্তমানে কর্পোরেট অফিসগুলোতে যথাসময়ে কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিকে প্রমোট করা হয়। কিন্তু সরকারের এসব গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে অফিস কখনো শেষ হয় না। প্রিয়জন যতই অসুস্থ থাকুন না কেন ছুটি চাওয়ার পরিবেশটিই নেই। এমনকি নিজের স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময়ও অনেক সময় হয় না। কয়েক বছর আগে জামালপুরের একজন সহকারী কমিশনার কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। অনেকদিন ধরে অসুখে ভুগলেও সময়ের অভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন নি বা নিবিড় পরিচর্যায় থাকতে পারেন নি। প্রথমে যেই ইউএনও মহোদয়ের কথা দিয়ে আলাপ শুরু করেছিলাম তার একটি কন্যা সন্তান আছে। তিনি দুঃখ করে বলেছেন যে তার মেয়ে তাকে খালা ডাকে কারণ সারাদিন তাকে যে দেখাশুনা করে সেও তাকে খালা ডাকে। মানুষ হিসেবে আমরা সবাইই কিছু আরাধ্য লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবনের বড় কিছু বিষয় ত্যাগ করি। একটি সম্মানজনক ও ক্ষমতা চর্চার চাকরি করতে আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে পিছপা হই না। এর পেছনে অন্য কিছু করার সুযোগ না থাকা ও সমাজের বাস্তবতা প্রধান কারণ। চেয়ার ছেড়ে গেলে সমাজে কীরকম মূল্যায়ন করা হয় সেটা উপলব্ধি করেই আমরা এই মোহ থেকে বের হতে পারি না।

বর্তমান প্রজন্ম এখন এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসার রাস্তা খুঁজছে। বর্তমানে দেশের মেধাবী মুখগুলো সুযোগ পেলেই আইইএলটিএস বা জিআরই পরীক্ষা দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমান। সেখানে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগকে কাজে লাগান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ ও বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ায় মনোযোগী হন। খুব অল্প কিছু শিক্ষার্থী দেশের পাবলিক সেক্টরে কাজে আগ্রহী হন। বর্তমানে পাবলিক সেক্টরে কাজের পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। অনেক সুযোগ সুবিধা বেড়েছে কিন্তু একজন সৃজনশীল মানুষকে যথাযথ কাজে লাগানোর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রশাসনে চাকরি বাহির থেকে অনেক আকর্ষণীয় মনে হলেও বাস্তবে এটি একটি কারণিক সেবা। যেখানে নাগরিকদের সেবা প্রদানই মুখ্য। নানা কারণে সেই সেবাটি যখন নিশ্চিত করা যায় না বা যথাসময়ে নিশ্চিত করা যায় না তখন যিনি কাজটির সঙ্গে যুক্ত থাকেন তিনিও মোটিভেশন হারান। বর্তমান প্রজন্ম শত বছর আগের তৈরি করা কাঠামোতে কাজ করার চাইতে সৃষ্টিশীল উপায়ে কাজ করতে আগ্রহী। সরকারের উচিত হবে কারণিক কাজগুলো আরও সৃজনশীল উপায়ে সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।

যদিও বিগত বেশ কয়েকটি বিসিএস এ আবেদন পূর্বের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে কিন্তু বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তাদের অনেকেই এই জবগুলোকে কাজের প্রেশার অনুযায়ী আন্ডারপেইড/আন্ডারপ্রিভিলেজড মনে করেন। বর্তমান প্রজন্ম দেখছে যেই শ্রম এই জবগুলোতে দিতে হয় তা অন্য করপোরেট সেক্টরে দিলে কয়েকগুণ বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। একজন সফল উদ্যোক্তার প্রথম দশ বছরের আয় একজন সচিবের সারাজীবনের আয়ের কয়েকগুণ হতে পারে। দেশসেবার ব্রত নিয়ে সবাই সরকারের এসব চাকরিতে প্রবেশ করেন কিন্তু কিছুদিন পরেই উপলব্ধি করেন তিনি আসলে কোনো মূল্য সংযোজন করতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বর্তমান প্রজন্মের চাকরিজীবীরা। কাজের যথার্থ মূল্যায়ন, কর্মক্ষেত্রে রিল্যাক্স, মানসিক প্রশান্তি এসবই এখনকার তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা।

লেখক: প্রভাষক ও পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), বিডিইউ ক্যারিয়ার সেন্টার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

মেসেঞ্জার/হাওলাদার