ঢাকা,  সোমবার
১৯ মে ২০২৫

The Daily Messenger

‘ফুড সেফটি থেকে কিছুদিন পর বদলি হয়ে গেলাম’

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ২৪ মে ২০২২

আপডেট: ১৭:২৯, ২৪ মে ২০২২

‘ফুড সেফটি থেকে কিছুদিন পর বদলি হয়ে গেলাম’

‘‘আমাদের ডাক্তার সাহেবরা অনেক সময় বলে থাকেন, লিভার ক্যান্সারের একটি বড় কারণ জর্দা, খয়ের এবং গুল। এই ধারণা থেকেই একদিন চিন্তা করলাম, কী আছে এর ভিতরে। মাথায় ততদিনে জগদ্দল পাথরের মতো বসে গেছে হেভিমেটাল আর হেভিমেটাল।

পুরান ঢাকার বাজার থেকে খ্যাত-অখ্যাত অনেকগুলো জর্দা, খয়ের এবং গুলের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করতে দিলাম। পরীক্ষার ফলাফল ভয়াবহ। সিসা, ক্যাডমিয়াম আর ক্রোমিয়ামে ভরা এই তিন আইটেম। পরিষ্কার হলো লিভার আর মুখের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হতে পারে এই আইটেমগুলো। আমার পরিবারের দুইজন মারা গেছেন লিভার ক্যান্সারে, যারা মারাত্মকভাবে জর্দা খেতেন।

একজনের একপাশের দাঁতের মাড়ি ক্যান্সারজনিত কারণে পুরো কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তিনি সবসময় গুল লাগাতেন মুখে।

বাজার থেকে কেনা জর্দা, খয়ের এবং গুলের এসব নমুনায় খুব বেশি মাত্রায় হেভিমেটাল পাওয়া গেলে সচেতনতার জন্য তা প্রকাশ করা হয় প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে। কারও বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। কারণ বিষয়টি নিয়ে এর পূর্বে কেউ অবগত ছিলেন না।

আপত্তি জানালেন জর্দার প্রথিতযশা এক কোম্পানি। তিনি জানালেন তার কোম্পানির জর্দায় কোনোপ্রকার হেভিমেটাল নেই এবং তিনি সন্দেহ পোষণ করলেন বাজার থেকে আমার নমুনায়ন নিয়ে। তার কোম্পানির নামে নকল জর্দা আমি নিয়ে এসেছি খোলাবাজার থেকে কিনে।


তিনি চ্যালেঞ্জ দিলেন, সবাই মিলে তার কোম্পানি ভিজিট করে সেখান থেকে অফিসিয়ালি বিধিমোতাবেক নমুনা নিয়ে তা পরীক্ষা করার জন্য। আমি বললাম, অফিসিয়ালি নমুনা নিয়ে সেটাতে হেভিমেটাল পাওয়া গেলে কিন্তু মামলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তিনি মেনে নিলেন।

পরীক্ষা করে ঐ একই পরিমাণ হেভিমেটাল পাওয়া গেলো। এরপর তার কারখানা সিলগালা করে আদালতে মামলা দায়ের করা হলো। পুরো কাজটি করলেন সিটি করপোরেশন দক্ষিণের পরিদর্শক মো. কামরুল হাসান। শুনেছি সেই মামলা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিত করা হয়েছে।

এরপর ৬৪ জেলা প্রশাসকের কাছে পত্র দেওয়া হলো, তাদের আওতাধীন এলাকায় সমস্ত জর্দা, গুল এবং খয়ের উৎপাদন, বিপণন, বিক্রয় বন্ধ করে দেওয়ার জন্য।

সারাদেশ থেকে অসংখ্য উৎপাদনকারী আমার অফিস রুমে এসে হাজির। তাদের দাবি ঐ চিঠি প্রত্যাহার করতে হবে। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, আপনারা নিজেরাই আপনাদের উৎপাদিত জর্দা, গুল এবং খয়ের ভালো ল্যাবে পরীক্ষা করে আমাকে রিপোর্ট জানাবেন প্লিজ।

একদিন তারা অফিসে এসে হাজির হলেন। প্রায় ৫০/৬০ জন। রুমে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। মুচকি হেসে বললাম, সবাই রিপোর্ট বলেন। তারা সবাই চুপ, মাথা নিচু করে আছেন।

কী, চুপ করে আছেন কেন!! কিছু পেয়েছেন কিনা?

সবাই মাথা নেড়ে জানালেন, পেয়েছেন। পরিমাণ? প্রশ্ন করলাম। অনেক স্যার, যেমন আপনি পেয়েছেন।

এখন বলেন, এই পরিমাণ হেভিমেটাল প্রতিদিন কেউ খেয়ে বা ব্যবহার করে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে উৎপাদক বা ব্যবসায়ী হিসেবে আপনারা আল্লাহপাকের কাছে দায়ী হবেন কিনা অথবা তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে কিনা?
সবাই বললেন হ্যাঁ স্যার, কিন্তু চুপ থাকলেন।

এখন আবার বলেন, এটা দেখার পর আমি আপনাদের ব্যবসা করার সুযোগ দিলে বা ঐ চিঠি প্রত্যাহার করলে বা চেপে গেলে বা গোপন করলে আল্লাহপাকের কাছে পরকালে দায়ী হবো কিনা?

সবাই জানালেন হ্যাঁ স্যার।

কাজেই ঐ চিঠি আমি প্রত্যাহার করবো না। চলে গেলেন সবাই।

ফুড সেফটি থেকে কিছুদিন পর বদলি হয়ে গেলাম। এরপরের কাহিনী বলার প্রয়োজন নেই।

এখন আপনাদের সিদ্ধান্ত, জর্দা, খয়ের এবং গুল খাবেন বা ব্যবহার করবেন কিনা। আমি আমার দায়িত্ব সঠিভাবেই পালন করেছি। আল্লাহপাক সাক্ষী।’’

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।

ডিএম/ইএইচএম