ঢাকা,  শুক্রবার
০৩ মে ২০২৪

The Daily Messenger

পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প জানতে ও জানাতে ইউএনওর ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ

এসকে দোয়েল, পঞ্চগড়

প্রকাশিত: ২১:১৩, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প জানতে ও জানাতে ইউএনওর ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ

ছবি : মেসেঞ্জার

ফেসবুক ইউটিউব জুড়ে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গল্প। ভিডিও চিত্রে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা মহান মুক্তিযুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন সে গল্প বলছেন একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সান্নিধ্যে মিশে সেই মূল্যবান গল্প সংগ্রহ করেছিলেন পঞ্চগড়ের আটোয়ারী সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মুসফিকুল আলম হালিম। একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হওয়ায় সরকারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভেবেছিলেন অনেক কিছুই।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিভিন্ন ঘটনাবলীকে সংরক্ষণ করতে ছুটে গিয়েছেন অত্র উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তাদের মুখ থেকে শোনা সেই গল্প তুলে ধরেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে, ইউটিউবে। এছাড়াও ডকুমেন্টারি আকারে আর্কাইভে রেখে দিয়েছেন।

গত ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মো: মুসফিকুল আলম হালিম। দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর চলতি সালের জানুয়ারীতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদলিজনিত কারণে বদলী হয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলায়। কিন্তু সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালনকালে বদলে দিয়েছেন অনেক কিছুই।

সমাজের উঠতি বয়সী তরুণ, শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ মাদকাসক্ত পরিবেশ থেকে রক্ষা করতে সচেতনতার লড়াই করেছেন। বই পাঠে অভ্যস্ত করতে গড়ে তুলেছিলেন মিনি লাইব্রেরী। সেই মিনি লাইব্রেরী এখন রূপ নিয়েছে গ্রন্থ কুটির। গ্রন্থকুটিরে সংগ্রহ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ক অনেক বই।

প্রায় ৭০ বিঘা সরকারি খাস জমি উদ্ধার করে ৭১ শতক খাস জমির উপর নির্মাণ করেছিলেন ৭১ আশ্রয়ন প্রকল্প। সেখানে স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চকে স্মরণ করে নির্মাণ করেন ২৬টি আশ্রয়নের ঘর। এই আশ্রয়ন প্রকল্পেই প্রায় ১১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে 'মসজিদুত তাকওয়া' মসজিদ নির্মাণ করেছেন।

এছাড়াও আশ্রয়ন প্রকল্পগুলোতে 'মসজিদে হানজালা'সহ বিভিন্ন মসজিদ ঘর নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রেখে বদলি হয়েছেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায়।

মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা বিষয় নিয়ে ইউএনও মো: মুসফিকুল আলম হালিম জানান, আমার বাবা মো. রহমত উল্ল্যা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ছোট বেলা থেকেই বাবার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছিলাম। গত ২০২১ সালে পঞ্চগড়ে আটোয়ারীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদানের পর এখানকার যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই জানার চেষ্টা করি।

তাই কাজের মধ্য দিয়েই সময় বের করে শতাধিকের বেশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছি, তাদের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি তা ডাটা সংগ্রহ কথোপকথনের ভিডিও চিত্র ধারণ করে তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ফেসবুক ইউটিউবে শেয়ার করেছি। ডকুমেন্টেশন করা হয়েছে। যাতে তরুণ নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধগুলো জানতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে দেশপ্রেমে আবদ্ধ থাকতে পারে।

১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল পঞ্চগড় দখল করে হানাদার বাহিনী। সাড়ে সাত মাস যুদ্ধের পর যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী পিছু হটলে ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় মুক্ত হয়। কৃষি নির্ভর এলাকাটিতে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস রয়েছে। আটোয়ারী উপজেলা গেজেটভূক্ত সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩৬৭ জন। যুদ্ধাহত শহীদসহ মোট বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এখানে প্রায় ৪০০ জন। বর্তমানে জীবিত রয়েছেন ১৭০ জন। সময়ের সাথে সাথে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আমরা হারাচ্ছি।

প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধার আছে যুদ্ধকালীন ইতিহাস। সে সময় যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই নিরক্ষর হওয়ার কারণে নিজেরা তাদের স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করেনি। মৃত্যুর কারণে প্রতিনিয়ত তাদের যুদ্ধের স্মৃতিকথা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে! তাদের স্মৃতিকথা প্রচারের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন: ইউটিউব, ফেসবুকের ব্যবহার করা হয়েছে ডকুমেন্ট সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

সে প্রেক্ষিতে অত্র উপজেলার শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন স্মৃতিকথা তাদের বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে আবার কখনও তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী জায়গায় ভিডিও চিত্র ধারণ করে ডিজিটালি সংরক্ষণ করা হয়। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, তারা নিভৃতে জীবন-যাপন করছেন। তাদের সাথে কথা বলে অজানা অনেক কিছুই জানা সম্ভব হয়েছে। এই তথ্য সংগ্রহ করতে যেয়ে তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ ছিলেন মুজাহিদ যারা ভারতে যেয়ে ট্রেনিং করেননি, আবার কেউ কেউ একই জায়গায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিন্তু যুদ্ধ করেছেন ভিন্ন জায়গায়।

ইউএনও আরও বলেন, আটোয়ারীর বেশিরভাগ বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছেন পঞ্চগড় জেলার আশেপাশেই। অনেকেই অসুস্থ থাকায় বা পুরনো স্মৃতি মনে করতে না পারায় তাঁদের গল্পগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। হাজারো কাজের ব্যস্ততায় চেষ্টা করা হয়েছে জাতির বীর সন্তানদের কাছ থেকে স্মৃতিগুলো ধরে রাখার। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ছুটির দিনগুলোতে ছুটে যাওয়া হয়েছে বীর নিবাসগুলোতে।

বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালকে দেখার স্মৃতিচারণ করেন এবং অনেকেই ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে যাবার ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমান পঞ্চগড় রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামেই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা অনেকের বয়স হয়েছে, শারীরিক অসুস্থ অনেকে। সময়ের পরিক্রমায় অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা নেই। যাদের ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়েছে তাঁদের প্রায় সবাই আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর পৃথিবীতে থাকবেন না কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি থাকবে জীবন্ত সবার মধ্যে, যতদিন বাংলাদেশ নামক একটি দেশ থাকবে গোটা দুনিয়ার বুকে।

আশা করা যায়, যুগের পর যুগ এই স্মৃতিচারণ সংরক্ষিত থাকবে সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে যাবে। ভবিষ্যত প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে। সঠিক ইতিহাস জেনে পরবর্তী প্রজন্মের দেশপ্রেম গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনস্মার্ট বাংলাদেশবিনির্মাণে উদ্যোগটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

আটোয়ারীর সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো: নজরুল ইসলাম বলেন, ইউএনও মো: মুসফিকুল আলম হালিম স্যার আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনের পরেও দেখেছি তিনি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সম্মান, শ্রদ্ধা করতেন আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার জীবন নিয়ে কথা বলতেন। আমাদেরকে নিজের পিতার মতো দেখেছেন সম্মান করেছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শুনতেন। সেগুলো আবার ভিডিও ধারণ করে প্রচার করতেন। এছাড়াও তিনি ৭১ আশ্রয়ন প্রকল্পে ঘর নির্মাণ করে তার নাম দিয়েছেন ৭১ আশ্রয়ন প্রকল্প

তিনি এখন কুড়িগ্রামের সদর উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। তার এই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আর্কাইভ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নতুন প্রজন্মের জন্য অনেক কাজে লাগবে বলে মনে করি।

মেসেঞ্জার/আপেল

dwl
×
Nagad

Notice: Undefined variable: sAddThis in /mnt/volume_sgp1_07/tp4l1yw3zz9u/public_html/bangla/details.php on line 700