ছবি : মেসেঞ্জার
গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র দাবদাহে ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চলতা। এতদিন টানা তাপপ্রবাহ এর আগে কখনো দেখেনি কেউ।
চলতি বছর দেশে গত ৭৫ বছরের তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভেঙেছে। এরমধ্যে হিটস্ট্রোকে চট্টগ্রামে অন্তত ৮ জন মারা গেছেন এ ক'দিন। ঘরে ঘরে ডায়রিয়া ও জ্বরে ভুগছেন মানুষ।
তীব্র গরমে ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। এছাড়া গরমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেড়েছে ডায়রিয়া ও শিশু রোগীর সংখ্যা। ফলে ওয়ার্ডের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বহির্বিভাগেও রয়েছে রোগীদের চাপ। প্রতিদিন গড়ে গরমজনিত কারণে ৫০০-৭০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
তীব্র গরমে বাইরে বের হলে মনে হচ্ছে তাপে মুখ ও শরীর পুড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সর্দি-জ্বর এবং পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছেন অনেকে। গরমের মধ্যে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এ পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) কালুরঘাট ফেরিতে মো: মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী নামে মাদ্রাসার এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বোয়ালখালীর খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক। চিকিৎসকদের ধারণা হিটস্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে।
২৮ এপ্রিল সকালে মিরসরাইয়ে মঘাদিয়া ইউনিয়নে প্রচণ্ড গরমে মাথা ঘুরে পড়ে জাহাঙ্গীর আলম (৫৩) নামে এক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মারা গেছেন।প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তিনি হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন।
জাহাঙ্গীর আলম মঘাদিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জাফরাবাদ গ্রামের কামাল চেয়ারম্যান বাড়ির দেলোয়ার হোসেনের পুত্র। ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের আনোয়ারায় রোশমিয়া জেবিন (১৬) নামের এক স্কুলছাত্রীর হিটস্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়।
হিট স্ট্রোকে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারকে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। সে বটতলী এলাকার মনির আহমদ চেয়ারম্যান বাড়ির ফরিদ আহমেদের মেয়ে। ১৯ এপ্রিল আনোয়ারা উপজেলায় হিটস্ট্রোকে শাহজাদা ছালেহ আহমদ শাহ (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তিনি রায়পুর ইউনিয়নের উত্তর পরুয়াপাড়া এলাকার হজরত আহমদ হাসানের ছেলে।
২৬ এপ্রিল পটিয়ায় হিটস্ট্রোকে মোজাম্মেল হক (৭৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড মাঝের ঘাটার বাসিন্দা। ২২ এপ্রিল কর্নেল হাট শ্যামলী বাস কাউন্টারের সামনে হিটস্ট্রোকে শুকুর আলী নামের এক যুবক টেম্পোর মধ্যে মারা গেছেন। সে লক্ষ্মীপুর জেলার দালাল বাজারের হাজীবাড়ির মৃত মানিক মিস্ত্রির ছেলে। তিনি সীতাকুণ্ডে জলিলের সিডিএ এলাকার বুলু মেম্বারের ভাড়া ঘরে থাকতেন।
এদিকে ১৯ এপ্রিল বোয়ালখালী উপজেলায় সাফা নামের ছয় মাস বয়সী এক কন্যা শিশুর মৃত্যু ঘটে। সে পশ্চিম শাকপুরা ২নম্বর ওয়ার্ড আনজিরমারটেক সৈয়দ আলমের নতুন বাড়ির মো. নিজাম উদ্দীনের মেয়ে। চিকিৎসকরা ধারণা করছেন সে হিটস্ট্রোকে মারা গেছে।
এছাড়া ২১ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার হাঈদগাও ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিম তালুকদারের বড় ছেলে জয়নুল আবেদীন দিদার (৫৮) হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। একই ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের সামশুল আলম (৭০) হিটস্ট্রোকে মারা যান। তিনি ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য।
চিকিৎসকরা বলছেন, গরমের সময়য় অসুস্থতা থেকে বাঁচতে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। এই সময়ে অস্থিতে ভোগার পাশাপাশি ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, বমির মতো অসুস্থতা লেগেই আছে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে আরও কিছু অসুখের।
অতিরিক্ত গরমের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকির লক্ষণগুলো সম্পর্কে চিকিৎসকরা বলেন, অস্বস্তি বোধ করা, ডিহাইড্রেশন, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, নিদ্রাহীন, শরীর ব্যথা, পেশি ব্যথা, খাবারের প্রতি অনীহা, ত্বকের ক্ষত, কিডনি, ডায়াবেটিস ও ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, হার্টের সমস্যা, হিট স্ট্রোক ও হিট ক্যাম্প।
যার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন শিশু প্রতিবন্ধী, মজুর, রিকশাচালক, কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক এবং অতিরিক্ত স্থূল ব্যক্তি। বিশেষ করে যাদের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের মতো একাধিক জটিলতা রয়েছে।
এদিকে তাপপ্রবাহ বাড়ায় ইতোমধ্যে ৫ বার হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহেও থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া গরমের তীব্রতা বাড়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইসিডিডিআরবি স্বাস্থ্যবিধি জারি করেছে। কিছু নির্দেশিকা দিয়ে জনগণকে তা মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
একই সঙ্গে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণের জন্য ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করতে অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গরমের মধ্যে কিছুদিন থেকে রোগী বেড়েছে জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেন, সর্দি, জ্বর, কাশি শ্বাসকষ্ট নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত গরমে শিশুরা প্রচুর ঘামছে,তাতে তৈরি হচ্ছে পানিশুন্যতা। এ সময় শিশুদের বাইরে বের না করলেই ভালো। শিশুদের খাবারের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। গরম খাবার দিতে হবে।
এছাড়া গ্রীষ্মের এই অসহনীয় গরম থেকে স্বস্তি পেতে প্রাপ্তবয়স্করা একটু পর পর চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দেয়া, তৃষ্ণা পেলে পানি পান করা, বাইরে বের হলে সঙ্গে ছাতা রাখা, চশমা ব্যবহার করা এবং কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতে হবে।
ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের পানি পান করানোর কোনও প্রয়োজন নেই। তাদেরকে এসময় 'অটিফিশিয়াল মিল্ক না দিয়ে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর পরামর্শ চিকিৎসকদের। একই সঙ্গে গরমের সময়ে শিশুদের অন্য সময়ের চেয়ে বেশি বুকের দুধ পান করানোর কথা বলেছেন।
আইসিডিডিআরবি বলছে, তীব্র ঘামে শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, রিকশাচালক,কৃষক ও নির্মাণশ্রমিকদের মত শ্রমজীবী, স্থূলকায় ব্যক্তি এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ, বিশেষ করে যাদের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন ব্যক্তিরা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে আইসিডিডিআরবি।
এর মধ্যে রয়েছে- বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা ও রোদ এড়িয়ে চলা। বাইরে বের হলে যতটা সম্ভব ছাতা, টুপি বা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখা, বিশেষ করে সুতির তৈরি হালকা রঙের পোশাক পরা,পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা, সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করা এবং বাসি, খোলামেলা খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলা।
একই সঙ্গে দিনের বেলা একটানা ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকা, একাধিকবার গোসল করা বা সম্ভব হলে পানি ছিটিয়ে দেয়া।
এছাড়া জন্মগত প্রস্রাবের রংয়ের দিকে নজর রাখা। তা যদি হলুদ বা গাঢ় হয়,তাহলে পানি পানের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া। খেয়াল রাখতে হবে ঘরের পরিবেশ যেন অতিরিক্ত গরম বা বাপ না হয়। একই সঙ্গে অসুস্থবোধ করলে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে।
মেসেঞ্জার/আকাশ/আপেল