ঢাকা,  মঙ্গলবার
১৪ মে ২০২৪

The Daily Messenger

বিশ্বকাপ ফুটবল মাঠে মা নেচেছেন বিজয়ের উল্লাসে

প্রকাশিত: ০২:২৪, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২

বিশ্বকাপ ফুটবল মাঠে মা নেচেছেন বিজয়ের উল্লাসে

আমার জন্মে আজান হয়েছিল, বাড়িতে খুশির বন্যা কিছুক্ষণের জন্য হলেও বয়েছিল, তবে ইতিহাস লেখা হয়নি। দেশ স্বাধীনে আমিও হরতাল থেকে শুরু করে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয়ের মাসে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছি, আমাকে নিয়ে ইতিহাস লেখা হয়নি। বড় বড় লোকদের ভীড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে আমার কথা কেউ বলেনি। আমার কথা লেখা রবে না, আমার কথা বলা হবে না। 

তবুও আমি সেই বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা এবং আমার মতো লাখো লাখো দেশপ্রেমিক এখনও বেঁচে আছে যাদের ঋণ কোনোদিনও শোধ হবে না এবং এ ঋণ শোধ করার জন্যও দেওয়া হয়নি। এ ঋণ আজীবন লাল সবুজের সাথে মিশে থাকবে। অনেকে ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকবে, পড়ে থাকবে জীবনের দীনতা হীনতা নিয়ে। তবে আমাদের কথা রবে সাধারণ মানুষের ভীড়ে, মাঠে ঘাটে ঘরে কিষাণ কিষাণীর মুখে, স্মৃতি বেদনার আঁখি, নীড়ে এবং তখনই মনে হবে—হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা, তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না।

বিজয়ের মাসে আমি স্বাধীনতার স্মৃতিচারণ করতে আসিনি বরং মুছে যাওয়া দিনগুলো যা আমাকে বার বার হাতছানি দিয়ে পিছে ডাকে, হৃদয়ের রক্তমাখা ঘটনাগুলো ছবি হয়ে বার বার ফিরে আসে, সেই দিনগুলোর কথা আজ শেয়ার করতে এসেছি।

তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ নামটি বিশ্ব মানচিত্রে লিখেছি সেই ১৯৭১ সালে, তখন বিষয়টি এত গভীরভাবে বুঝিনি যা এখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি। আমরা সবাই প্রতিদিনই কিন্তু ভালো-মন্দ কিছু করি। জানা-অজানা, ভালো-মন্দের হিসাব-নিকাশ সব সময় করিনা। মনের অজান্তে যদি খারাপ কিছু করি তার জন্য আমরা অনুতপ্ত হই, ভালো কিছু করলে উৎফুল্লতা বোধ করি।

দেশ স্বাধীন করা ছিল আমাদের সকলের জন্য একটি বিশাল বড় দায়িত্ব। এ দায়িত্ব কম বেশি সবাই তখন পালন করেছিল। কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে পারিনি। তারপর বেশ অল্প বয়সেই দেশ ছেড়েছি। বাইরে লেখাপড়া করতে যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তা নিজেই ম্যানেজ করেছি ছোটখাটো চাকরি করে। পরে লেখাপড়া শেষে যে চাকরিটি প্রথম করি সেটা ছিল আসল চাকরি।

আশ্চর্য পড়ালেখার সাথে সাথে এত বছর কাজ করলাম এবং সেই অর্থের সুবাদে শেষ চাকরিটা হলো, তারপরও অতীতের চাকরিগুলোর মূল্যায়ন ঠিকমতো কখনও দেওয়া হলো না। জীবনে কিন্তু এভাবেই বড় বড় লোকদের ভীড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে আমার কথা কেউ যেমন বলে না, আমি নিজেও নিজের অনেক কথা বলি না! কারণ আমাদের ছোট-খাটো কর্মের অনেক কিছুই বড় বড় দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মাঝে হারিয়ে যায়।

আমি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি পেলাম এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি বড় দায়িত্ব পেলাম। তৎকালীন বিশ্বের যে সমস্ত শিশুর শরীরে গ্রোথ হরমোনের অভাব ঠিক তাদের জন্যই আমার কোম্পানি ফার্মাসিয়া, মূলত ওষুধটি তৈরি করেছে এবং আমি সেই ওষুধটির সঙ্গে শতভাগ জড়িত।

একটি অসুস্থ শিশু আর দশজন শিশুর মতো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে, পৃথিবীর দায়িত্ব নিবে, এমনকি বিশ্বসেরা ফুটবলার হবে এ বিশ্বাস আমার মনে জন্মেছিল। যখন প্রথম জেনেছিলাম আর্জেন্টিনার ছোট্ট একটি ছেলে ভালো ফুটবল খেলে কিন্তু শরীরে গ্রোথ হরমোনের অভাব, চিকিৎসার অভাবে অঙ্কুরে ঝরে যাবে! ফার্মাসিয়ার সেই গ্রোথ হরমোন শিশুটিকে সত্যিই বিশ্বসেরা ফুটবলার হতে সাহায্য করেছে।

শুধু লিওনেল মেসি নয় লাখো লাখো প্রতিভাসম্পন্ন শিশু আজ বড় হয়ে বিশ্বের গুরুদায়িত্ব পালন করছে। দেশ যেমন স্বাধীন হয়েছে তারপর কতকিছু হয়ে এবং বয়ে চলছে দেশের উপর দিয়ে কিন্তু আমার কথা কেউ মনে রাখেনি, আমি সেই ঝরা পাতা যে একদিন হলেও দুলেছিল, একদিন হলেও গাছটিকে আর দশটি পাতার মতো তার সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলো। কিন্তু তারপরও পাতা ঝরে যাবে নতুন পাতা হবে।

সদ্য শেষ হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। সবার মুখে মেসির কথা, তাকে নিয়ে ইতিহাস হবে কিন্তু কেউ জানবে না সেই গ্রোথ হরমোনের কথা বা ফার্মাসিয়ার কথা এমনকি আমার কথা। আমরা পৃথিবীর বুকে কম বেশি সবাই কোনো না কোনোভাবে কিছু না কিছু ভাল কাজ করি কিন্তু সব সময় তার জন্য ক্রেডিট পাই না।

শরতে সুইডেনে গাছের সব পাতা ঝরে যায়, রাস্তা-ঘাট ঝরা পাতায় পরিপূর্ণ হয়। তখন মনে হয় পাতাগুলো শুধু আবর্জনা। আমরা ভুলে যাই একদিন এই পাতাগুলোর কারণে বসন্তে বাহার এসেছিল, ফুল ফুটেছিল, ফল হয়েছিল! পাতা ঝরে যাবে, নতুন পাতা গজাবে, আমিও একদিন ঝরাপাতার মতো ঝরে যাবো এবং মিশে যাবো তাদেরই মাঝে! কিন্তু ঝরে যখন এখনও পড়িনি তাই মন থেকে কিছু কথা বলে যেতে চাই এবারের ফুটবল বিশ্বকাপের ওপর।

আমি ইউরোপ থেকে ফুটবল, টেনিস নিয়ে লিখি। আমার ছেলে-মেয়ে খেলাধুলার সাথে জড়িত, আমি নিজেও জড়িত। আমি ইউরোপে আছি বলে কি নিজের শিকড় ভুলে যেতে পারি? যে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ ফুটবল উন্মাদনায় মাতেন, আমিও একদিন সেই দেশেই ছিলাম, সেই উত্তেজনা আমার হৃদয়েও কাজ করে। 

বিশ্বকাপ ফুটবলটা এক মাসের আয়োজন। এই সময়টা আনন্দ, হাস্যরস করে কাটালে সমস্যা কী? তবে এর মানে এই নয়, এই ইস্যুকে কেউ বাড়াবাড়ি করে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। ফুটবলীয় হাস্যরস অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অনেকেই অনেককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনফ্রেন্ড পর্যন্ত করে দিয়েছে। ভাবা যায়, খেলাকে কোথায় নিয়ে গেছে মানুষ! বাংলাদেশে ফুটবলীয় হাস্যরস বোঝার মতো ক্ষমতা এখনো অনেকেরই হয়নি! ফুটবলটা অনেকের কাছে শুধু বিনোদন নয়, বরং ম্যাডনেস।

ইউরোপে এক পক্ষ আরেকপক্ষকে নিয়ে গানে গানে হাস্যরস করে। তবে ওরা দেশীয় সমর্থকদের মতো অর্বাচীন নয়। আসুন বরং দেশ গঠনে খেলাধুলার প্রতি জোরালো হই। 

আমি বহু বছর আগে বিশ্বাস করেছি মেসিকে, আমি টেনিসে বিশ্বাস করেছি আমার ছেলে-মেয়েকে, আমি ফুটবলে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে বিশ্বকাপে এ বিশ্বাস করি। ফুটবল, টেনিস, ক্রিকেটসহ সব খেলাধুলোই কিন্তু বিনোদনের একটি বড় অংশ। কিছু সমর্থক এটিকে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলছেন এবং হাস্যরস করতে করতে কোনো একসময় ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন যা বিনোদনের উপলক্ষ হয়ে উঠছে সংঘাতময়। অনেকেই বিনোদনের উদ্দেশ্যে খেলা না দেখে প্রতিপক্ষের সমর্থকের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে।

কোথায় আর্জেন্টিনা, কোথায় ব্রাজিল কোথায় ফ্রান্স—দিন শেষে আমরা একে অন্যের আপন। অথচ সাময়িক বিনোদন, হাস্যরস না বুঝে একে অন্যের প্রতি হিংসাত্মক হয়ে মারামারি করছে দেশ জুড়ে! অনেকে মেরে নিজ ভাইয়ের মাথা ফাটিয়েছে। যাদের জন্য এটা করা হচ্ছে তারা কখনো জানতেও পারবে না। জানলে আমাদের মতো সমর্থক তারা চাইবে না। কারণ, তারা জানে, ফুটবল বিনোদনের খোরাক, আর বিনোদন দিতে এসে কোনো ভায়োলেন্স হবে, সেটা কখনোই প্রত্যাশিত নয়।

মেসির জন্য হয়তো এটাই শেষ বিশ্বকাপ। খেলাধুলোই হার-জিত থাকবে, এবার বিশ্বকাপে জিতেছে মেসির দল। খেলার ফলাফল যায় হোক না কেন, আর কখনো সমান উন্মাদনা নিয়ে তাকে দেখা হবে না বিশ্বকাপে। নতুন লিজেন্ডরা আসবে, তবে যারা ভালো কিছু দিয়ে যাবে তারা সারা জীবন বেঁচে থাকবে আমাদের অন্তরে। তবে দিন শেষে সবাই ঝরে যাবে এবং সবাই কার্বন হয়ে ফিরে যাবে মাটিতে।

বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ৩২টি দেশ বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছে এটা একটি বিশাল অ্যাসিভমেন্ট। তারপর এ বছর সব মহাদেশ থেকে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছে। সর্বশেষে চারটি দেশের মধ্যে আফ্রিকার মরক্কো টিকেছে, আরও মজার ব্যাপার কাতার একটি মুসলিম দেশ বিশ্বকাপ ফুটবলের হোস্ট হতে পেরেছে। 

আরও মজার বিষয় মুসলিম দেশের এক মা বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে নিজ ছেলের হাত ধরে বিজয়ের উল্লাসে নেচেছে, শুধু পতাকা নয় নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে দেশের, জাতির, মহাদেশের তথা সারা জাহানের জাগ্রত জনতার ভিড়ে একজন মুসলিম খেলোয়াড় তার মাকে সম্মানে ভূষিত করেছে, এটা ছিল আমার কাছে ভালোবাসার তাজমহল যা আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছি।

সদ্য বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শেষ হয়ে গেল। ফুটবল আবার আসবে ফিরে চার বছর পরে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে আমাদের মাঝে। যে দেশের মানুষ আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সমর্থনে মারামারি করে আহত হয় এবং ব্রাজিলের পরাজয়ের দুঃখে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে, সেই দেশ কেন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় নিজেদের দল পাঠানোর স্বপ্ন দেখতে পারবে না?

আমাদের দেশের সন্তানেরা বিশ্বকাপ একবারে আনতে না পারলেও আমরা অংশগ্রহণ করে আশপাশের অনেক দেশের চেয়েও ভালো করতে পারব এবং মাথা উঁচু করতে পারব। পারব সোনার বাংলার পতাকাকে তুলে ধরতে সারা বিশ্বের মাঝে, যেন ‘বল বীর বল চির উন্নত মম শির...’।

বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করবে। খেলার শুরুতে সবাই জাতীয় সংগীত গাইতে থাকবে। তখন আনমনে আমি দাঁড়িয়ে যাব, গায়ের লোমগুলো হয়তো দাঁড়িয়ে যাবে, আমার দু’চোখ বেয়ে পড়বে শত আনন্দের অশ্রুধারা, বুকে হাত রেখে তাল মিলিয়ে গাইতে থাকব-‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি!’

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]

dwl

Notice: Undefined variable: sAddThis in /mnt/volume_sgp1_07/tp4l1yw3zz9u/public_html/bangla/details.php on line 770