ছবি : মেসেঞ্জার
নরসিংদী সদর উপজেলার বীরপুর গ্রামে 'আরিয়ান পোল্ট্রি' খামারটি ৩টি দপ্তর থেকে বন্ধ করে দেয়ার রায় হলেও রায়ের বাস্তবায়ন নেই। তাছাড়াও গত এক বছরের বেশি সময় ধরে পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে খামারটি।
প্রচণ্ড তাপমাত্রায় খামার থেকে দুর্গন্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে, চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
ভুক্তভোগীরা বলছে খামারটি সরিয়ে নেয়ার রায় হবার প্রায় ৮ মাস অতিক্রম হলেও বাস্তবায়ন হয় নি। ফলে, খামারের গন্ধে বাড়ী ছেড়ে দেয়া ভুক্তভোগীরা তাদের বাড়ীতে ফিরতে পারছেন না।
তারা বলছেন, রায় বাস্তবায়ন দূরের কথা উল্টো অভিযোগকারীদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। হুমকি ও মারধরের ঘটনায় নরসিংদী সদর থানায় পৃথক ৩ টি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। আবার এসব অভিযোগ প্রত্যাহার করতেও বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে খামারটির মালিকের বিরুদ্ধে।
এর আগে গত বছরের ৭ অক্টোবর নরসিংদী সদর আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলামও লিখিতভাবে নরসিংদী জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরকে খামারটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছেন।
জানা যায়, খামার থেকে আসা মুরগীর বিষ্ঠার তীব্র গন্ধে কয়েকটি পরিবার চার বছর ধরে বাড়ি ছাড়া রয়েছে। এ ছাড়াও এলাকায় খামার মালিকটির ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ গ্রামে প্রায় ১৫ হাজার নাগরিক বসবাস করছেন।
খামারটির পাশের জমি তার কাছে নামে মাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। খামারটির দক্ষিণ পাশের জমি শামসুদ্দিন খোকনের ১০.৫ শতাংশ জমিও দখল করেছেন অভিযুক্ত আরিয়ান পোল্ট্রি খামারটির মালিক সালাহউদ্দিন। জমি দখলের ঘটনায় গত সেপ্টেম্বরে থানায় লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগী এবং পাশাপাশি নরসিংদীর দেওয়ানি আদালতে একটি মামলাও চলমান রয়েছে।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তর গত ১০ সেপ্টেম্বর, আরিয়ান পোল্ট্রি খামারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ঢাকার ইনফোর্সমেন্ট শাখা। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর নরসিংদী পৌরসভার শালিসি আদালত ১ মাসের মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে খামারটি সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন মেয়র আমজাদ হোসেন বাচ্চু।
একই বছরের ৮ অক্টোবর নরসিংদী সদর উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভুমি) মেহেদী হাসান কাউছার খামারটি তিন দিনের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি নরসিংদী জেলা প্রাণী সম্পদও ছাড়পত্র নবায়ন স্থগিত করে দেয়।
ভুক্তভোগী সাহিদা আক্তার (৪৮) বলেন, "মুরগীর বিষ্ঠার গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে গত চার বছর ধরে পরিবার নিয়ে বাসায় থাকতে পারছি না। এখন কখনও মেয়ের শুশুড়ের বাসায় আবার কখনও অন্য কোনো আত্বীয় বাসায় থেকে দিন কাটাতে হচ্ছে। আমার সেই রকম আয়ও নেই যা শহরে ভাড়া বাসা নিয়ে থাকবো।
আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করলেও রায় হয় কিন্তু কি কারণে খামারটি সরিয়ে নিচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় খামারের মালিককে কিছু বলতেও পারছি না।"
ভুক্তভোগী মাহমুদা বেগম শিউলি (৪৩) বলেন, "রায় হলেও রায়ের বাস্তবায়ন নেই। বরং উল্টো ঝামেলায় পড়ি, দিন দিন বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। তার কাছে আমরা অসহায়। জায়গা ছেড়ে দিতে খামারটির গন্ধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।"
"স্থানীয় প্রভাবশালীসহ বিভিন্নভাবে নিয়মিত ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। অনেক কষ্ট করে সহায় সম্বল বিক্রি করে বাড়ি কিনেছি ২০০৭ সালে। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে বাড়ি খামারটির বিষ্ঠার দুর্গন্ধে বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে একাধিক সালিশেও সরানো যায় নি খামারটি।
রায় হলেও প্রভাবশালী হওয়ায় রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমরা হতাশ এবং আদৌ বাড়িতে ফিরতে পারবো কিনা আমরা সন্দিহান", বলেন আরেক ভুক্তভোগী হোসেন আলী (৬০)।
অভিযুক্ত আরিয়ান পোল্ট্রি খামারের মালিক সালাউদ্দিন বলেন, "আল্লাহ্র উপর ভরশা নিয়ে খামারটি চালাচ্ছি। বিভিন্ন দপ্তরে কাগজপত্র জমা দেয়া আছে। তারা নবায়ন না দিলে আমি কি করতে পারি? প্রাণি সম্পদ দপ্তরের ২০২৪ সালের নবায়ন আছে। আমি কাউকে হুমকি দেয় নি। আর তারা ইচ্ছে করে বাড়ী ছেড়ে দিলে আমি কি করতে পারি? আমারও ব্যবসা করার অধিকার রয়েছে।
নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, "আমাদের পৃথক তদন্ত কমিটি খামারটি বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণ ও স্থানীয়দের হয়রানির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। গত ১ বছর ধরে খামারটির ছাড়পত্র নবায়ন স্থগিত করা হয়েছে। আমরা একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। অচিরেই আমরা এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে।"
নরসিংদী জেলা প্রাণী সম্পদ তপ্তরের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, "আমাদের ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি আরিয়ান পোল্ট্রি খামারের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তার খামারের উৎপাদন এ বছর থেকে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নতুন করে উৎপাদনে যেতে পারবে না।"
নরসিংদী জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম বলেন, "আরিয়ান পোল্ট্রি খামারের দূষণের বিষয়ে আমরা অবহিত আছি। আমাদের তদন্ত টিমও খামারটির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পেয়েছে। এটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। অচিরেই খামারটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।"
মেসেঞ্জার/কাউছার/আপেল