ছবি: মেসেঞ্জার
নরসিংদীর পলাশে ইছাখালী ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম করে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
অভিযোগ আছে, পরীক্ষার দুইদিন আগে অধ্যক্ষ কয়েকজন প্রার্থীকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেছেন।
এছাড়া, পরীক্ষার আগে ওই প্রার্থীদের সঙ্গে তিনি একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করেছেন, যার মধ্যে তিনটি কল রেকর্ড ছড়িয়েছে।
অভিযুক্ত অধ্যক্ষ আ ক ম রেজাউল করীমের বিরুদ্ধে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ছাড়াও, ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে এতিমখানার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে।
মাদ্রাসা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ ডিসেম্বর ৩টি শূন্যপদের বিপরীতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞপ্তিতে ইবতেদায়ী শাখার প্রধান, কম্পিউটার অপারেটর ও ল্যাব সহকারী পদের জন্য জনবল চাওয়া হয়।
৫ সদস্যের নিয়োগ কমিটির মধ্যে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ ছিলেন সদস্যসচিব। তিনি ছাড়াও নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ছিলেন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি সভাপতি আবু কাউছার কিরণ, সদস্য ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল মোমেন, মশিউর রহমান ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (দাখিল ও ইবতেদায়ী) নাদিয়া মাহমুদ।
কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ৩৫ নম্বরের পরীক্ষার মধ্যে গণিত, বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার ও অন্যান্য বিষয়ের প্রত্যেকটিতে ৭ নম্বরের প্রশ্ন থাকবে।
তিনটি পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন ১৭ জন। ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) প্রধানের পদে ৩ জন ছাড়াও কম্পিউটার অপারেটর ও ল্যাব সহকারী পদে ৭ জন করে আবেদন করেছিলেন।
ল্যাব সহকারী পদে আবেদন করেছিলেন শিবপুর উপজেলার সাধারচর ইউনিয়নের কালোয়াকান্দা গ্রামের আব্দুর রহিম আফ্রাদের মেয়ে উম্মে হাফসা।
হাফসার সঙ্গে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিমের ৩ বারে মোট ৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ড কথা হয়।
কল রেকর্ডের বিষয়টি চাকরিপ্রার্থী হাফসার বাবা আব্দুর রহিম আফ্রাদ নিশ্চিত করে বলেন, 'কল রেকর্ডটি আমার মেয়ে উম্মে হাফসা ও রেজাউল করিমের মধ্যকার কথোপকথন।'
তবে, কথোপকথনের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হাফসাকে ফোন দেওয়া হলে, নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
হাফসার বাবা বলেন, 'আবেদন করার পর ইছাখালী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম আমাকে ও আমার মেয়েকে ফোন করেন। তিনি তার অফিসে আমাকে ৪ দিন ডেকে নিয়ে কথা বলেন এবং মেয়েকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেন। চাকরি নিশ্চিতের জন্য তিনি প্রথমে ১ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে আমরা গ্যারান্টর হিসেবে ৭০ হাজার টাকা দিতে রাজি হই। কিন্তু তার দাবিকৃত ১ লাখ টাকা পরীক্ষার আগে পরিশোধ না করায় এবং অন্য প্রার্থীর কাছ থেকে বেশি টাকা পাওয়ায় আমাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেন।'
তিনি বলেন, 'রেজাউল করিম আমার মেয়েকে পরীক্ষার দুইদিন আগে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন। যেহেতু গ্যারান্টি দেননি, তাই মেয়েকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেইনি। টাকা নিলে বুঝতে পারতাম, চাকরি হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'তবে, রেজাউল করিমসহ ওই মাদ্রাসার এক সহকারী শিক্ষক মোস্তফা কামাল সোমবার বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসে আমার কাছে এ বিষয়ে আর কিছু না বলার জন্য অনুরোধ করেছেন।'
তবে, চাকরির বিনিময়ে মোট কত টাকা লেনদেন করেছেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান হাফসার বাবা আব্দুর রহিম।
যোগাযোগ করা হলে নিয়োগ কমিটির সদস্য মশিউর রহমান বলেন, '৩৫ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাউকে আগেই প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়েছে কিনা জানি না। আমি প্রশ্নপত্র করার দায়িত্বে ছিলাম না। অধ্যক্ষ এ বিষয়ে ভালো জানেন।'
হাফসাকে চাকরি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত রেজাউল করিম বলেন, 'আমি পরীক্ষার আগে বন্ধুর মেয়ে হিসেবে সাজেশন দিয়েছিলাম, প্রশ্নপত্র দেইনি। সব পরীক্ষার আগেই সাজেশন দেওয়া হয়, তাই আমিও দিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।'
তিনিও আরও বলেন, 'আইন অনুযায়ী পরীক্ষার আগে আমি সাজেশন দিতে পারি না। কিন্তু মানবিক কারণে হাফসাকে সাজেশন দিয়েছি। সবচেয়ে বড় বিষয় যাকে সাজেশন দিয়েছি, সে পরীক্ষায় উপস্থিত হয়নি।'
জানতে চাইলে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. কারিউল্লাহ বলেন, 'পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন মাদ্রাসায় গিয়েছি দুপুর বেলা। গিয়ে দেখি পরীক্ষার পর খাতা মূল্যায়ন করা হয়ে গেছে। নিয়োগ বোর্ডের ভাইভাতে বসা হয়নি।'
অভিযুক্ত অধ্যক্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তার কিছু সমস্যা আছে। আগেও তার বিরুদ্ধে এতিমখানার টাকা আত্মসাতসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। যদি নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি অনিয়ম করে থাকেন, যদি প্রমাণ থাকে, সংবাদ করেন, অনিয়মের বিরুদ্ধে আমার সহায়তা থাকবে।'
এতিমখানার টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে ইছাখালী দারুল মাসকিন ইসলামিয়া এতিমখানার পরিচালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের মাদ্রাসা ও ইছাখালী ফাযিল ডিগ্রি মাদ্রাসা দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মাদ্রাসা অধ্যক্ষ জেলা প্রশাসন থেকে এতিমখানার নামে দুই টন চাল বরাদ্দ এনেছিলেন ছয় মাস আগে। আবার তিনি আমাদের মাদ্রাসার সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় এতিমখানার অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল ১২ লাখ টাকা। কমিটির পরিবর্তন হওয়ার পর এখন তিনি বলতেছেন, ফান্ডে আছে দুই লাখ টাকা। অ্যাকাউন্ট হিসাবও বুঝিয়ে দিচ্ছেন না।'
নিয়োগে অনিয়মের জানতে চাইলে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আবু কাউছার কিরণ বলেন, 'আমি নিয়োগ পরীক্ষার অনিয়মের বিষয়ে জানি না। যদি হয়ে থাকে, প্রমাণ দেন, ব্যবস্থা নেব।'
যোগাযোগ করা হলে নরসিংদীর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোবারুল ইসলাম বলেন, 'নিয়োগের বিষয়টি শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের হাতে নিয়োগের বিষয় নেই। তবে, অনিয়ম হলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।'
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম বলেন, 'আমরা বিষয়টি অবগত নই। যদি নিয়োগ পরীক্ষায় বা নিয়োগে কোনো অনিয়মের অভিযোগ প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়, তাহলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
মেসেঞ্জার/কাউছার/ফারদিন
