ডেমরায় বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসি প্রধান সংবাদ সম্মেলন করছেন। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর ডেমরায় অছিম পরিবহনে আগুন দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে এমনটা ঘটিয়েছেন আসামিরা। নির্দেশদাতাদের খুঁজতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।
শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম মনির ওরফে মনির মুন্সি, নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব মো. সাহেদ আহমেদ, বিএনপি কর্মী এবং মনির মুন্সির ব্যক্তিগত গাড়িচালক মাহাবুবুর রহমান সোহাগ।
২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর। ডেমরায় দাঁড়িয়ে থাকা অছিম পরিবহনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার নাইম ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর অপর হেলপার রবিউল দীর্ঘদিন ছিলেন মৃত্যুশয্যায়। পরে থানায় মামলা হলে রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। টানা ৬ মাস অনুসন্ধানের পর ক্লুলেস এ মামলার রহস্য উদঘাটন করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। জড়িত থাকার অভিযোগে এরইমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩ জনকে। সিসিটিভির ফুটেজে আসামিদের জড়িত থাকার সত্যতাও পেয়েছেন তারা। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার সকলেই বিএনপির সক্রিয় সদস্য।
সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টন এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালায় বিএনপি। এ দিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা, অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটান দলটির নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাতে ডেমরা থানাধীন দেইল্লা বাস স্ট্যান্ডে রাখা অছিম পরিবহনের একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার মো. নাইম (২২) ঘটনাস্থলে আগুনে পুড়ে মারা যান এবং অপর হেলপার মো. রবিউল (২৫) অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হন। এ ঘটনায় ২৯ অক্টোবর ডেমরা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অ্যান্টি ইলিগাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিমে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্তের প্রথমেই দুইজন ভুক্তভোগীর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত মো. নাইমের (২২) বাড়ি বরিশালের কোতোয়ালি থানায়। নাইমের বাবার নাম আলম চৌকিদার এবং মায়ের নাম পারভীন বেগম। তারা ডেমরা এলাকাতেই থাকতেন। অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা ফেরানোর জন্যই অল্প বয়সে কাজে নেমে পড়েন নাইম। অবশেষে বাসের ভেতর ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান তিনি। অপর ভুক্তভোগী মো. রবিউল (২৫) একই বাসে নাইমের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন। আগুনের তাপে ঘুম ভেঙে যায় তার। কিন্তু ততক্ষণে রবিউলের শরীরেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় গাড়ি থেকে তিনি বের হয়ে আসেন। পরে পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তদন্তভার গ্রহণের পর ঘটনাস্থলের চারপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে একটি হ্যারিয়ার গাড়ি শনাক্ত করা হয়। ওই গাড়িটি ঘটনার দিন অগ্নিসংযোগে ব্যবহৃত হয়েছিল। এ গাড়ির সূত্র ধরে ঢাকা মেট্রোপলিটনের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মূল অগ্নিসংযোগকারী ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার এবং ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়িটি জব্দ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানান, নাশকতা অব্যাহত রাখার জন্য মনির মুন্সি তার নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েছিলেন। নির্দেশনার মূল বিষয়বস্তু ছিল, নাশকতার মাত্রা আরও বাড়ানো এবং এমন কোনো ঘটনা ঘটানো যাতে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তারই অংশ হিসেবে তিনি বেশ কয়েকজনকে অগ্নিসংযোগের জন্য নিয়োগ দেন। তিনি নিজে বড় একটি ঘটনা ঘটানোর জন্য তার অপর সহযোগী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিব এবং তার বন্ধু সাহেদ আহমেদকে ডেকে নেন।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওই দিন গভীর রাতে ডেমরার দেইল্লা বাস স্ট্যান্ড এলাকা কয়েকবার রেকি করেন। অবশেষে তারা কাঙ্ক্ষিত টার্গেট ফিক্সড করে বড়ভাঙা মার্কেটে চলে যান। সেখান থেকে তারা ২ লিটারের পানির বোতলে পেট্রোল সংগ্রহ করেন, রাত ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ঘটনাস্থলে নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার মাহাবুবুর রহমান সোহাগ গাড়িতে অবস্থান করেন এবং মনির মুন্সি ও সাহেদ পেট্রোলের বোতল নিয়ে রাস্তার পাশে পার্ক করা অছিম পরিবহনের গাড়ির কাছে যান। ড্রাইভারের সিটের পাশে থাকা খোলা গ্লাসের অংশ দিয়ে মনির মুন্সি পেট্রোল ঢেলে দিয়ে বোতলটিও সেখানে ফেলে দেন। তারপর দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরিয়ে সেই কাঠি পেট্রোলের উপর ছুড়ে মারে। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়লে, তারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
হামলাকারীরা সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর জন্য সড়কের রং সাইড দিয়ে ডেমরা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে সুফিয়া কামাল ব্রিজ দিয়ে ভুলতায় থাকা মনির মুন্সিদের মালিকানাধীন মুন্সি পেট্রোল পাম্পে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন সকাল ১০টার দিকে তারা পেট্রোল পাম্প থেকে বাসায় চলে যান।
তিনি বলেন, এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ ক্লু-লেস ছিল। আমরা বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করে ও তদন্ত করে একটি গাড়ি শনাক্ত করি। পরে সেই গাড়ির সূত্র ধরে একে একে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আগুন দেয়ার জন্য দুই লিটারের একটি পানির বোতলে মোটরসাইকেল থেকে পেট্রোল সংগ্রহ করে, সেটিও জব্দ করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, মনির মুন্সি নির্দেশদাতাদের থেকে নির্দেশনা পেয়ে এ কাজ করেন। তিনি আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। দলের আরও বড় পোস্ট পাওয়ার আশায় এ কাজ করেন তিনি। এ ঘটনায় নির্দেশদাতাদের শনাক্ত করা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নির্দেশদাতাদের নাম পেয়েছি৷ তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের বিষয়ে এখনই কোনো তথ্য আমরা বলব না।
২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর সারাদেশে আতঙ্ক তৈরি করতেই বাসটিতে আগুন দেয়া হয়। বাসে আগুন দেওয়ার কাজে জড়িত একটি প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মেসেঞ্জার/হাওলাদার